যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ নিঃসঙ্গ।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আজ নিঃসঙ্গ। ক্ষমতার দম্ভ সব সময় থাকে না। যে ট্রাম্প দুইদিন আগেও ক্ষমতার উচ্চশিখরে বসে জাহির করেছেন নিজেকে আজ সে নিঃসঙ্গ। পরিবারের মানুষ ছাড়া কেউ তেমন পাশে নেই। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘সুসময়ে অনেক বন্ধু বটে হয়, অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়।’ আজ ট্রাম্পের অবস্থা হয়েছে সে রকম।একে একে সরে যাচ্ছে তার পাশের মানুষেরা। মিডিয়া থেকে শুরু করে তার দলের লোকেরা পর্যন্ত। ক্ষমতার চাবি যে হারাতে বসেছেন ট্রাম্প এটা এখন প্রায় পরিষ্কার। বসন্তের কোকিলেরা তার পাশে থেকে তাকে বাহবা দিলেও তার আচরণ মেনে নিলেও, মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও এখন তা প্রকাশ পাচ্ছে।তার বিপরীতে কথা বলতে শুরু করেছেন তারা। যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যে সৌন্দর্য ছিল তা ট্রাম্প ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন ভোট নিয়ে অপ্রত্যাশিত, মিথ্যে

জালিয়াতির অভিযোগ তুলে। এমন কি গতকাল জনসম্মুখে ট্রাম্প বক্তব্য দিতে আসলে তার ভিত্তিহীন বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করলে এমএসএনবিসি সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। সিএনএনএনের সাংবাদিক এন্ডারসন কুপার বলেছেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিকে আমরা দেখছি, যেন রোদে পোড়া স্থূল কচ্ছপের মতো। ভাসতে ভাসতে যে মনে করছে তাঁর সময় শেষ হয়ে আসছে।’ট্রাম্পের লাগামহীন কথা বার্তা জনগণ বিরক্ত। তার কাছের মানুষেরা এখন দূরে সরে যাচ্ছেন। টুইটারে অনেকে ইতিমধ্যে টুইট করে ব্যঙ্গ করা শুরু করেছেন ট্রাম্পকে নিয়ে।পুরো বিশ্বের চোখ এখন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে দিকে। কি হতে যাচ্ছে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা। তিন তারিখ নির্বাচন হলেও ফলাফল এখন ঝুলে আছে কিছু রাজ্যে ভোট গণনা সম্পন্ন হয়নি বলে।

জর্জিয়া, নেভাদা, পেনসিলভানিয়া রেড থাকলে তা আস্তে আস্তে ব্লু হতে চলেছে। শুধু নর্থ ক্যারোলাইনা এখনো রেড আছে। কিন্তু তা দিয়ে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় পুনরায় যেতে পারছেন না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ভোট যত কাউন্ট হচ্ছে ফলাফল ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেনের দিকে অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর হাতছানি দিচ্ছে। ফলে সাদা দালানের ক্ষমতা থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছেন ট্রাম্প। সূর্য ডুবার মত ট্রাম্পের ক্ষমতাও ডুবতে বসেছে। অন্ধকার হাতছানি দিচ্ছে তাকে ঘিরে। সূর্যাস্তের বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে ট্রাম্পের আক্ষেপ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেইইতিহাসের রেকর্ড ভেঙ্গে সবচেয়ে বেশী ভোট পড়েছে এবারের মার্কিন নির্বাচনে। পপুলার ভোটে বাইডেন জয়ী তবে ইলেক্টোরাল ভোটের রেজাল্ট এখনো ঝুলে আছে। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে এখনো ফলাফল না আসলে ও অনেকে অগ্রিম অভিনন্দন জানাতে শুরু করেছেন ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেনকে।

তিনি যে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন তাতে এখন আর বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই। ডাকযোগের ভোট গণনা হচ্ছে বলেই ফলাফল দিতে দেরী হচ্ছে। এবার ডাকযোগে প্রায় ১০ কোটি ভোট পড়েছে। যা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হবে অচিরেই। যদি ও ট্রাম বলেছে ভোট গণনা বন্ধ করতে। আর মার্কিন ইতিহাসে এই প্রথম কোন প্রেসিডেন্ট ভোট গণনা শেষ না হতেই নিজেকে জয়ী বলেও ঘোষণা দিয়েছিলেন। যদি ও জনগণ থেকে মিডিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থা ছিল সারা বিশ্বে অনুকরণীয়। নির্বাচন কত সংখ্যক ভোটার অংশগ্রহণ করেছে সেটা ব্যাপার ছিল না। সবাই দেখেছে সুস্থ ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে কিনা। জনগণের মতামত প্রতিফলিত হচ্ছে কিনা। কিন্তু এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন অযৌক্তিকভাবে কিছু দাবী তুলে। নিউ ইয়র্ক টাইমস বলেছে, ১৯০৮ সালের পর এবার যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশী ভোটার অংশ গ্রহণ করেছে। ১৯০৮ সালে ভোটারের ৬৫ শতাংশ ভোট দিয়েছিল আর এবার৬৭ শতাংশ অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচন শুধু প্রেসিডেন্টের মধ্যেই হচ্ছে না সাথে সিনেট (উচ্চ-কক্ষ) প্রতিনিধি পরিষদ (নিম্ন-কক্ষ) ও হচ্ছে । সিনেটে এ পর্যন্ত সমানে সমান লড়াই হচ্ছে। ডেমোক্রেট ৪৮ সিট এবং রিপাবলিকানদের দখলে ৪৮। আর নিম্ন-কক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ৪৩৫টি আসনের মধ্যে ডেমোক্রেটিক ২০৯ আর রিপাবলিকানরা পেয়েছেন ১৯২ সর্বশেষ খবর জানা পর্যন্ত।

আমেরিকার গণতান্ত্রিক, মতপ্রকাশে, মানবাধিকার বিশ্বাসে একটি রাষ্ট্র। জনগণ চায় রাষ্ট্রপতি হবে একজন উদার নৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী। তিন তারিখ নির্বাচনের পর থেকে এপর্যন্ত যেসমস্ত বক্তব্য ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন তাতে জনগণ এখন মনে করছেন জো বাইডেন জয়ী হলে ভুল হবে না।ট্রাম্পের দাম্ভিকতা লাগামহীন আচরণ তাকে জনগণের কাছ থেকে অনেক আগেই সরিয়ে নিয়েছে। শুধু ক্ষমতার পালা বদলের অপেক্ষায় ছিল জনগণ। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন গত চার বছরে ট্রাম্প আমেরিকার গণতন্ত্রের সৌন্দর্যটা বিলোপ করে দিয়েছেন। যা এর আগে অন্যকোন প্রেসিডেন্ট করেনি।আজকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে দারিয়ে ও জো বাইডেন বলছেন আমাদের গণতন্ত্রের জয় হোক। জনগণ এটাই শুনতে চেয়েছে। তিনি ক্ষমতার যত কাছাকাছি আসছেন ততই নমনীয় হচ্ছেন। বাইডেন মূলত রাজনীতিবিদ, দীর্ঘকালের রাজনীতির অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে। তিনি ছিলেন সনেটরও। বিশেষ করে তার মার্জিত আচরণ, নমনীয়তা এবার নির্বাচনে প্রভাব পড়েছে। ট্রাম্প শিবিরে যেখানে ট্রাম্পের জয় পাবার কথা সেসব রাজ্যে তিনি হানা দিয়েছেন ভোটের লড়াইয়ে।

এবারের নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে করোনা ভাইরাস। প্রায় দুই লাখের উপর মানুষ মারা গেছে। অনেকের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। এজন্য জনগণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন। প্রথম থেকেই যদি ট্রাম্প পদক্ষেপ নিতেন জোরালোভাবে তাহলে হয়ত এত মানুষের মৃত্যু হত না। শুধু আমেরিকা নয় এ নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও সমালোচনায় মুখোর ছিল। বিশ্বের শক্তিশালী এমন উন্নত রাষ্ট্রে কি করে এত মানুষের মৃত্যু হতে পারে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে এর মধ্যে হানা দিয়েছে ফলে জনগণ বিশ্বাস হারিয়েছে ট্রাম্পের উপর। ভোট বিপ্লবের মধ্যেই নীরবে জনগণ প্রতিবাদ জানিয়েছে বলা যায়। এটাই আমেরিকার গণতন্ত্র। নির্বাচনে জালিয়াতি,কিংবা কারচুপির করে নয় জনগণ চায় তাদের মতামতের ভিত্তিতেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোক। এবং এভাবেই হয়ে আসছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে

বসে তা অনুধাবন করতে পারেননি। এখন তিনি অনেকটাই বিমর্ষ। ক্ষমতার দাম্ভিকতা তাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। ফলে নীরবে অনেকে সরে গেছে তার কাছ থেকে। আর এখন যখন পরাজয় দ্বারপ্রান্তে হাতছানি দিচ্ছে তা দেখে অনেকে তাদের মনের মধ্যে রাখা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। মুহূর্তেই চেনা মানুষেরা ট্রাম্পের কাছে অচেনা হয়ে উঠছে। এটাই ইতিহাসের ধারা। শুধু হোয়াইট হাউস না তার দলে মধ্যে তিনি কতটুকু প্রভাব ফেলবেন ভবিষ্যতে তা নিয়ে নিয়ে অনেকে সন্দিহান। ক্ষমতার পালা বদলে তার মূল্যায়নের ও যে পালা বদল হবে তা সহজে অনুমেয়। ক্ষমতা না ছাড়তেই হয়েছেন নিঃসঙ্গ। সময়, ইতিহাস মানুষকে শিক্ষা দিয়ে যায় । শুধু মানুষ বুঝে না, বুঝে সবকিছু হারিয়ে। ট্রাম্পের পাশে যে আজ কেউ নেই এখন তিনি তা উপলব্ধি করছেন ভালোভাবে।লেখক: কলামিস্ট, নিউ জার্সি থেকে