সজোরে আঘাত…ইলেকট্রিক শক…

আমার কাছে এলে পাবেন পুঁজের দুর্গন্ধ।’আহমেদ কবির কিশোর বা কার্টুনিস্ট কিশোর যেন এক কথায় জানিয়ে দিলেন তার ওপর নির্যাতনের ভয়াবহতার কথা।অকথ্য নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বললেন, ‘গতকালের আগের দিন কারা কর্মকর্তা আমার পায়ের ছবি তুলেছিলেন। কারা মহাপরিচালক আমার সঙ্গে দেখা করে বললেন, “দুই দিনের মধ্যে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। বাইরে গিয়ে কানের চিকিৎসা নিয়েন”।’

‘কারাগারের ডাক্তারকে অনেকবার বলেছি, আমাকে বাইরে নিয়ে চিকিৎসা করাতে। আমাকে বলা হয়েছে, এই মুহূর্তে আটক ব্যক্তিদের বাইরে নেওয়া যাবে না।’‘আমাকে অ্যান্টিবায়োটিক আর পেইনকিলার দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো কোনো কাজ করেনি।’‘আমাকে গত ২ মে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ইফতারের প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে। আমি তখন ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ দরজায় বিকট শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। দরজা খুলতেই সাদা পোশাকে ১৭ জনের মতো হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন। তাদের চার জনের কাছে ছোট অস্ত্র ছিল।’‘পরিচয় জানতে চাওয়ায় তারা ধমক দিলেন। একজন জানালেন, তার নাম জসীম। আমার পরনে লুঙ্গি থাকায় তারা আমার পোশাক বদলে শার্ট-প্যান্ট পরতে বললেন। কেন?— জানতে চাইলে জসীম বললেন, “যা বলেছি তাই করেন”।’

‘যে রুমে কম্পিউটার ও শিল্পকর্মগুলো ছিল আমরা সেই রুমে ছিলাম। জসীম সিগারেট জ্বালালেন। সিগারেট শেষ করে ফ্লোরেই ফিল্টার ফেললেন। আমি তাকে নিষেধ করে নিচু হয়ে ফ্লোর থেকে ফিল্টার তোলার সময় দেখি, একজন লাল ট্যাবলেটের প্যাকেট ও একটি আগ্নেয়াস্ত্র বের করে সেগুলো আমার বইয়ের ফাঁকে রাখছেন।’‘আমি চিৎকার করে তার হাত ধরে ফেললাম। তিনি ঝাটকা মেরে আমাকে সরিয়ে দিলেন। বললাম, আপনারা এমন করতে পারেন না। জানতে চাইলাম, তাদের কাছে কোনো ওয়ারেন্ট আছে কি না।’‘আমার চিৎকার শুনে জসীম তার লোকদের থামতে বললেন। আমাকেও সেখান থেকে বের হয়ে যেতে বললেন। আমি বের হতে অস্বীকার করি। আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, তারা আরও কিছু ঘরে রেখে দিতে পারেন।’‘এসবের কারণ কী?— জানতে চাইলে তারা বলেন, গাড়িতে ওঠার পর কারণ জানতে পারবেন।’

‘বাইরে এসে দেখি, নতুন দুই জনকে দিয়ে একটি জব্দ তালিকায় সই করানো হচ্ছে। তারা আমাকে মাংকি ক্যাপ পরিয়ে দেন। আমার মুখ থেকে ঘাড় পর্যন্ত ঢেকে যায়। গাড়িতে তোলার আগেই, সিঁড়িতে আমাকে হ্যান্ডকাফ পরায়।’‘মাংকি ক্যাপ পরিয়ে দেওয়ার আগে দেখতে পাই, আমার সামনে একটি ধুসর রঙের ভি-সিক্স। আরেকটা নিশান পেট্রল। একটার নম্বর প্লেটে খুব সম্ভব ‘ঢাকা মেট্রো ষ-১৮১২’ লেখা ছিল। সব গাড়িতেই গ্লাস টিনটেড ছিল।’‘গাড়িতে তোলার আগে আমার মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। তাই বলতে পারব না আমাকে কোন গাড়িতে তোলা হয়েছিল। তবে সেটা ভি-সিক্স হতে পারে।’‘কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে— জানতে চাইলে তারা বলেন, সব জানানো হবে। আরও বলেন, আমাদের সহযোগিতা করলে আমরাও আপনাকে সহযোগিতা করব।’

‘গাড়িতে একসময় তারা গান ছাড়েন। সাউন্ড দেন সর্বোচ্চ। হিন্দি গান শোনেন। এস ডি রুবেলের গান শোনেন। মনে হচ্ছিল তারা ফুল ভলিউমে গান শুনছিলেন কারণ আমি চিৎকার করলেও যেন বাইরের কেউ শুনতে না পায়।’‘প্রায় ৪০ মিনিটের মতো গাড়িতে ছিলাম। তারা গাড়িতে কোনো মারধর করেনি। তবে যখনই জানতে চেয়েছি আমাকে কেন অ্যারেস্ট করা হলো, তখনই তারা বলেছেন, “এতো বেশি কথা বলবেন না”।’‘গাড়ি রাস্তায় এক জায়গায় দাঁড়ালে বুঝতে পারলাম লোকজন ইফতার করছেন। হ্যান্ডকাফ থাকা অবস্থায় দুই হাতের তর্জনী দিয়ে ক্যাপটা একটু তুলতে পারলাম।’‘একটা বাড়ি থেকে একজন বের হলেন। তিনি গাড়িতে উঠলেন। আমি তার চেহারা দেখতে পাইনি। তার পায়ে মোকাসিনের জুতা দেখতে পাই। আমার সামনের সিটে একজন বসেছিলেন। তার হাতে সেল ফোন। আমি একটু ফাঁক দিয়ে ফোনের স্ক্রিন দেখতে পাই। স্ক্রিনে ম্যাপের মতো কিছু দেখাচ্ছিল। নম্বরসহ কালো টেক্সট বক্স দেখা গেল। তিনি আঙুল দিয়ে স্ক্রিনে নম্বরগুলো নাড়াচাড়া করছিলেন।’

‘ইফতারে পর গাড়ি আবার চলতে শুরু করে। গাড়ি থামলে আমাকে বের হয়ে আসতে বলেন। আমি বের হই। হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই। আমাকে টেনে-হেঁচড়ে রুমের ভেতর নিয়ে যাওয়া হয়।’‘আমাকে যে রুমে নিয়ে যাওয়া হয় মাংকি ক্যাপের ফাঁক দিয়ে সেখানে প্লাস্টিকের তিনটা চেয়ার দেখতে পাই। রুমের টাইলস মনে হলো পুরনো, স্যাঁতসেঁতে। পাশে এয়ারকন্ডিশনড রুম ছিল। সেখান থেকে ঠাণ্ডা বাতাস আসছিল। আমার হাত সামনে থেকে বাঁধা ছিল। একজন এসে তা পেছন দিকে বাঁধলেন।’‘আমার ডায়াবেটিস আছে। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে পারি না। খাবার চেয়েছিলাম। কেউ সাড়া দেয়নি।’

‘অনেকক্ষণ পর আমাকে অন্য একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। রুমটা একটু দূরেই ছিল। আমাকে একটা শক্ত চেয়ারে বসানো হলো। চেয়ারের হাতলে ও পায়ায় কিছু একটা ছিল। একজন আমার চোখ খুলে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, “ইফ ইউ লুক ব্যাক, ইউ উইল বি কিলড”। সেখানে ১০-১২ জনের মতো ছিলেন বলে মনে হলো।’‘তারা প্রজেক্টরের স্ক্রিনে একটা কার্টুন দেখালেন। আমি সেই কার্টুনে নানা দেশের ছবি দিয়ে মাদার নেচার এঁকেছিলাম। তারা জানতে চাইলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীকে এঁকেছি কি না।’‘আমি বললাম, না। এটা প্রকৃতিকে নিয়ে কনসেপচুয়াল কার্টুন। মহামারি থেকে বিশ্বকে মুক্তি দেওয়ার।’‘একটার পর একটা কার্টুন দেখিয়ে তারা বললেন, সেখানকার নারী ফিগারগুলো প্রধানমন্ত্রী ও পুরুষ ফিগারগুলো জাতির পিতা কি না।’

‘আমি তখন রাগ করে কথা বলছিলাম। বললাম, কার্টুনগুলো দেখে কি তাই মনে হচ্ছে? তখন তারা মোটা লাঠি দিয়ে আমার পায়ে আঘাত করলেন। লাঠির মাথায় স্টিলের নব ছিল। আমার সামনে আরও চারটি লাঠি ছিল।’‘একজন উঠে এসে তার হাত দিয়ে আমার মাথার দুই পাশে সজোরে আঘাত করলেন।’এতে কিশোর কানে প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন। সেসময়ই তার কানের পর্দা ফেটে যায় বলে জানান কিশোর।এভাবে জেরা চলল বেশ কিছুক্ষণ। যতবার তারা প্রশ্ন করছিলেন, কিশোর সরাসরি কোনো উত্তর দিচ্ছিলেন না। আর তখনই তাকে মারা হচ্ছিল।‘মাথার টুপিটা উঠে গিয়েছিল বলে আমার মাথার পেছনেও আঘাত করল।’কিশোরের পায়ে, পিঠে, মাথায় পেটানো হলো।কিশোর বলেন, ‘তারা আমার ইমেইল আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অ্যাকাউন্টগুলোর পাসওয়ার্ড চাইলেন। কিন্তু, তখন আমি ডান কানে কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। কান থেকে রক্ত পড়ছিল। তখন তারা আমাকে লিখে বললেন কী করতে হবে। আমিও লিখে জানালাম।’

তারা কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকলেন। ‘আই অ্যাম বাংলাদেশি’ নামে ফেসবুক পেজ থেকে কিশোরের পোস্ট শেয়ারের কারণে ওই পেজ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সুইডিশ-বাংলাদেশি সাংবাদিক তাসনিম খলিল, হাঙ্গেরিতে থাকা ব্যবসায়ী সায়ের জুলকারনাইন, জার্মানিতে থাকা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে তিনি কীভাবে চেনেন, তা জানতে চাইলেন।কিশোর আরও জানান যে, মৌলবাদী উগ্রপন্থীদের সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সে জড়িত কি না, তাও জানতে চাওয়া হয়।‘আমি বললাম যে, যাদের ওপর হামলা হয়েছে এবং যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার বন্ধুও আছে’, বলেন কিশোর।‘সেই রুমে আমাকে চার-পাঁচ ঘণ্টার মতো রাখা হয়েছিল। একসময় আজান শুনতে পাই। সেখানে তীব্র পেট্রলের গন্ধে আমার হাঁচি এল। অনেক গাড়ির আওয়াজও পাচ্ছিলাম।’একসময় কিশোর তাদের জানালেন যে, তার বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন, না হলে কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে।

‘বাথরুমটি নোংরা ছিল না, সেখানে দুর্গন্ধও ছিল না। তবে মেঝেতে অনেক রক্ত ছিল। তখনো আমার চোখ বাঁধা ছিল। তবে সে অবস্থায়ই কাপড়ের নিচ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম’, কিশোর বলেন।টয়লেট ব্যবহারের সময় চোখ খুলে দেওয়ার অনুরোধ করলেন তিনি। কিন্তু, এতে কেউ তার পেছনে লাঠি দিয়ে খোঁচা দিলেন আর তাকে সোজা হেঁটে গিয়ে প্রস্রাব করতে বললেন।কিছুক্ষণ পর তাকে আবার সেই প্রথম রুমে নিয়ে যাওয়া হলো।কিশোর বলেন, ‘আমার শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল। নাক-কান দিয়ে রক্ত পড়ছিল। সিদ্ধান্ত নিলাম বেরিয়ে যাব। দাঁড়িয়ে গেলাম, দরজাও খুলে ফেললাম। তখনই দুজন লোক এল। তারা বললেন যে, নড়াচড়া করলে মেরে ফেলবেন। আমার সঙ্গে এখনো কিছুই নাকি করা হয়নি বলে জানালেন তারা।’‘ভোরের দিকে কদমছাট দেওয়া একজন রুমে এসে বাসি পোলাও-মাংস খেতে দিলেন। কয়েক ঘণ্টা পর আবার জিজ্ঞাসাবাদ করার সেই রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে চলল একের পর এক প্রশ্ন, আর নির্যাতন।’‘আমি দিন-ক্ষণের হিসাব ভুলে গেলাম। দুই বারই খেতে দিয়েছিল। একবার নষ্ট পোলাও, আরেকবার প্যাকেটে করে কিছু একটা। তবে, চোয়ালে মুখে প্রচণ্ড ব্যথার কারণে কিছু খেতে পারিনি।’

একটা সময় সন্ধ্যার দিকে কিশোরকে খিলগাঁও র‌্যাব-৩ এর অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো।কিশোর বলেন, ‘সেখানে চোখ খুলে দেওয়া মাত্রই দেখলাম ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। তখনই সেখানে মুশতাক আহমেদকে (লেখক মুশতাক আহমেদ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কারাগারে মারা যান) দেখলাম। মুশতাক আমাকে বললেন, “বি প্রাউড ম্যান! তুমি কোনো অন্যায় করোনি”।’‘মুশতাকের গা থেকে প্রস্রাবের প্রকট দুর্গন্ধ আসছিল। তাকেও কয়েকদিন আগে তুলে আনা হয়েছিল। অনেক পেটানো হয়েছে, যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়েছে। মেঝেতে অনেকগুলো খবরের কাগজ পড়েছিল। সেগুলো দিয়ে তাকে শরীর পরিষ্কার করতে বললাম। সে তার আন্ডারওয়ার খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। দেখলাম সেটার মধ্যে মল-মূত্র লেগে আছে। জানাল যে, নির্যাতনের সময় প্যান্টেই মল ত্যাগ করে ফেলেছে’, কিশোর বলেন।‘একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট এলেন আমাদের জেরা করতে।’

কিশোর বলেন, ‘আমি বাথরুমে যাব বললাম। পরিষ্কার বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। এক কর্মকর্তা আমাকে তাদের ব্যবহারের বাথরুমে নিয়ে গেলেন। তিনি অন্য একজনকে বললেন আমার কান থেকে রক্ত পরিষ্কার করে দিতে। আমাকে চা-বিস্কুটও দেওয়া হলো।’‘ভোরের দিকে আমাদের দুজনকে রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। থানার ডিউটি অফিসার জানতে চাইলেন, নির্যাতন করা হয়েছে কি না। আমি বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু, মুশতাক আমাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, সত্য বলো না। সত্য বললে আরও নির্যাতন করা হবে।’‘এর কয়েক ঘণ্টা পর আমাদের কোর্টে নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় আমার দীর্ঘ ১০ মাস কারাভোগের কাহিনী।’ সুত্র:ডেইলিস্টার