ভোটের আগে আলটিমেটাম দেওয়ার চিন্তা হেফাজতের

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায় করতে চায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সেজন্য সরকারকে সময়সীমা বেঁধে (আলটিমেটাম) দেওয়ার চিন্তা করছে ধর্মভিত্তিক এই ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন। আগামীকাল বুধবার ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন থেকে হেফাজত নেতারা এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা দিতে পারেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

জানা গেছে, ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে মূল লক্ষ্য হলো কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং পূর্বঘোষিত ১৩ দফা দাবির বাস্তবায়ন। এ ছাড়া সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যুতেও সম্মেলনে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হবে। দাবি পূরণের জন্য সম্মেলন থেকে সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হতে পারে। ওই সময়ের মধ্যে দাবি মানা না হলে পরে আরও কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে।

হেফাজত নেতারা জানান, আগামীকাল বুধবার সকাল ৯টা থেকে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। সংগঠনের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংগঠনের অন্য নেতারা বক্তব্য দেবেন। সম্মেলনে সারা দেশ থেকে আলেম-ওলামারা অংশ নেবেন। ঢাকা মহানগর ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। ওলামা-মাশায়েখ

সম্মেলন সফল করতে ইতোমধ্যে সারা দেশে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে ১০টি সাংগঠনিক টিম গঠন করে গণসংযোগ করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী বলেন, ‘সম্মেলনের সার্বিক প্রস্তুতি ভালোভাবে শেষ হয়েছে। বিভিন্ন জোনে প্রচারণা ও দাওয়াতি কাজ করা হয়েছে। আলেম-ওলামা ও নেতাকর্মীদের সর্বোচ্চ উপস্থিতির বিষয়ে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। সারা দেশ থেকে সংগঠনের নেতাকর্মীরা আসবেন। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবেই জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন সম্পন্ন হবে। এ নিয়ে উদ্বেগ বা আতঙ্কের কিছুই নেই।

জানা গেছে, গত ২১ সেপ্টেম্বর হেফাজতের কেন্দ্রীয় মজলিসে আমেলার বৈঠকে ২৮ অক্টোবর জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ১০ দিন পর হেফাজতের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটি ঘোষণার তিন সপ্তাহের মাথায় প্রথম বৈঠকে বসেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা। তবে সরকার পতনের একদফা দাবিতে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দল ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ‘মহাসমাবেশ’ ডাকার পর ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনের তারিখ এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় হেফাজত।

অবশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে নয়, ভেন্যু জটিলতার কারণে সম্মেলনের তারিখ পরিবর্তন করতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন হেফাজত নেতারা। সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব মীর ইদরিস দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘যেখানে সম্মেলন হবে সেই হলটি বরাদ্দ নিতে হয়। ২৮ অক্টোবর হল বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। তাই তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন আয়োজনে ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অনুমতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন হেফাজত নেতারা।

সূত্র জানায়, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গত ১৯ অক্টোবর সকালে রাজধানীর উত্তরা দারুল উলুম বাবুস সালাম ফাউন্ডেশনে মাওলানা মাহফুজুল হকের সভাপতিত্বে জাতীয় ওলামা-মশায়েখ সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সম্মেলনের তারিখ পরিবর্তন করে ২৫ অক্টোবর (বুধবার) নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে এই কর্মসূচি সফল করতে রাজধানীকে ১০টি জোনে ভাগ করে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের আলোচনা সমাবেশের দীর্ঘ প্রায় ৯ বছর পর ২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলনে ব্যাপক লোকসমাগম ঘটিয়েছিল হেফাজত। ওই সম্মেলন থেকে সংগঠনের সাবেক আমির মরহুম শাহ আহমদ শফী ঘোষিত ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়ন, গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার, জাতীয় শিক্ষানীতিতে ধর্মীয় শিক্ষা সংকোচনের প্রতিবাদ, পাবলিক পরীক্ষায় ধর্ম বিষয়ে ১০০ নম্বরের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা ও জাতীয় শিক্ষা কমিশনে হাক্কানি আলেম প্রতিনিধি রাখার দাবি তুলে ধরা হয়। এসব দাবি নিয়ে ওই দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করে হেফাজতের একটি প্রতিনিধিদল।

এদিকে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে হেফাজতের উদ্যোগে ফের বড় ধরনের জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। অনেকে মনে করছেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন শক্তিশালী করতে ভোটের আগে ঢাকায় শোডাউন করছে হেফাজত। সরকারকে চাপে ফেলতে ২০১৩ সালের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে তারা। আবার কারও কারও মতে, সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সমঝোতা হয়েছে। এই সম্মেলনের পেছনেও সরকারের ইঙ্গিত থাকতে পারে। বিএনপির শেষ সময়ের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নিতেই হেফাজতকে সামনে আনা হচ্ছে।

তবে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের দাবি, এই সম্মেলনের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নেই। নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্য নিয়েই সমবেত হচ্ছেন তারা। এই সম্মেলন থেকে ২০১৩ সালের মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি করার চিন্তা নেই তাদের। ধর্ম অবমাননার জন্য মৃত্যুদণ্ডের আইন করাসহ ১৩ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ করেছিল হেফাজতে ইসলাম। দাবি আদায়ে ৬ মে রাতে হাজার হাজার নেতাকর্মী মতিঝিলে অবস্থান নিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সেখান থেকে হটিয়ে দেয়। সে সময় অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটে বলে হেফাজত দাবি করে আসছে।

পরে ২০২২ সালের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলাম ব্যাপক বিক্ষোভ ও হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করে। ওই কর্মসূচি কেন্দ্র করে হেফাজতের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের অনেকে বর্তমানে জামিনে মুক্ত হলেও কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা মনির কাসেমি, শিশুবক্তা হিসেবে খ্যাত মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানি, মাওলানা ফখরুল ইসলামসহ কয়েকজন কারাগারে রয়েছেন।