জমকালো আয়োজনে সুমনা-ইমদাদুলের বিয়ে

বগুড়ার টিএমএসএস অটিজম ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রে রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হয়েছে বরণ মঞ্চ। সেখানে লাল শাড়িতে বধূ বেশে সুমনা খাতুন (২০)। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন কনেপক্ষের নারীরা। সবাই একই রঙের শাড়ি পরেছেন। সবাই টিএমএসএস অটিজম ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রের শিক্ষিকা। কনেপক্ষের সঙ্গে ছিলেন টিএমএসএস রিলিজিয়াস কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দা রাকিবা সুলতানা। পাশেই লাল শেরওয়ানি-পাগড়িতে বর বেশে বসেছেন ইমদাদুল হক (২৪)। তাঁকে ঘিরে রেখেছেন একই রঙের পাঞ্জাবি পরা বরযাত্রীরা।

তাঁরাও সবাই ওই কেন্দ্রের শিক্ষক। বরপক্ষের সঙ্গে ছিলেন টিএমএসএস অটিজম ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আবদুর রউফ।যাঁদের ঘিরে এই বিয়ের অনুষ্ঠান, সেই ইমদাদুল হক ও সুমনা খাতুন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন (অটিস্টিক) তরুণ-তরুণী। তাঁরা দুজনই ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা। আজ সোমবার দুপুরে হয় এই বিয়ের অনুষ্ঠান। বিকেলে জমকালো আয়োজনে তাঁদের বিয়ের প্রীতিভোজে আমন্ত্রিত ছিলেন ১ হাজার ২০০ অতিথি।

টিএমএসএস অটিজম ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রে এটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন দুজন তরুণ-তরুণীর প্রথম কোনো বিয়ের আয়োজন। এ কারণে বিয়ের আগে গতকাল রোববার গায়েহলুদের অনুষ্ঠানও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে করা হয়। এতে বর-কনে উভয় পরিবারের ২০ জন ছাড়াও ৫০০ অতিথি উপস্থিত ছিলেন। অতিথিরা বর-কনেকে হলুদ মাখিয়ে দেন। গায়েহলুদ অনুষ্ঠানে অতিথিদের মিষ্টি, পিঠা ও পায়েস দিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হয়। রাতের নৈশভোজে ছিল বিরিয়ানির আয়োজন।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় হতদরিদ্র পরিবার তাঁদের একসময় বোঝা মনে করত। পরে অটিজম স্কুলে পড়াশোনা করেন দুজনই। সেখানেই তাঁদের মধ্যে সখ্যতা হয়।
আজ বেলা সোয়া দুইটার দিকে বিয়ের আসরে আনা হয় বর-কনেকে। ছেলেপক্ষের উকিল ছিলেন টিএমএসএস অটিজম ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুলের অধ্যক্ষ মাসুদুর রহমান। কনেপক্ষের উকিল হন টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম।

বিয়ের কলেমা পড়ান হোসনে আরা বেগমের ভাই পীর আবদুর রহমান। ১০ হাজার টাকা দেনমোহরে বিয়ে পড়ান তিনি। বিকেলে একই স্থানে বর ও কনের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবাই নববিবাহিত এই তরুণ-তরুণীকে দোয়া করেন। সেখানেই হয় প্রীতিভোজ অনুষ্ঠান। সেখানে সবার জন্য ছিল বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী আলু ঘাঁটি ও দই। অতিথিদের জন্য ছিল মাংসের রেজালা। বিয়েতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম কাওছার রহমান, সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান, সদর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুল মোমিন, প্রশাসনের প্রতিনিধি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাসনিমুজ্জামানসহ অনেকেই।

টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এমদাদুল-সুমনার বিয়ের আয়োজন করতে পেরে খুব ভালো লাগছে। তাঁরা যেন সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারেন, সে জন্য তাঁদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকার ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আমি চাই অসহায় মানুষের পাশে বিত্তবানেরা দাঁড়াবেন এবং এটি তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে শক্তি জোগাবে।’

কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে এই কেন্দ্র যাত্রা শুরু করে। তবে তারও এক বছর আগে এখানে ঠাঁই হয় বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ইমদাদুল হকের, তখন তাঁর বয়স ১৮ বছর। তাঁর বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থানগড়–সংলগ্ন রায়নগর ইউনিয়নের পলাশবাড়ি গ্রামে। তাঁর বাবা আবদুল জলিল পেশায় দিনমজুর। অন্যদিকে সুমনা খাতুন বগুড়া সদরের নুনগোলা ইউনিয়নের আশোকোলা গ্রামের দিনমজুর ইসলাম উদ্দিনের মেয়ে। ১৪ বছর বয়সে তাঁর ঠাঁই হয় এই কেন্দ্রে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হওয়ায় হতদরিদ্র পরিবার তাঁদের একসময় বোঝা মনে করত। পরে অটিজম স্কুলে পড়াশোনা করেন দুজনই।

কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সাঈদ যুবায়ের বলেন, তিন বছর আগেই তাঁদের মধ্যে ভাব গড়ে ওঠে। বিষয়টি নজরে এলে তিনি দুজনকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কথা বলেন উভয়ের পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু সুমনার বয়স কম হওয়ায় বিয়ের জন্য অপেক্ষা করা হয়। এর মধ্যে করোনার সংক্রমণ শুরু হলে বিয়ে পিছিয়ে যায়। শেষে সবার মতামত নিয়ে আজ বিয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়। গতকাল উৎসবমুখর পরিবেশে গায়েহলুদের অনুষ্ঠান হয়। বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, পুনর্বাসন কেন্দ্রের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু-কিশোর, টিএমএসএস রিলিজিয়াস কমপ্লেক্সের বাসিন্দারা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশার মানুষকে।