শাহাবুদ্দীন তালুকদার ২০০১ সালে বাবার দেওয়া ৬০ টাকা নিয়ে বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন কাজের সন্ধানে। তখন বয়স মাত্র ১৫/১৬ বছর।সেই শাহাবুদ্দীন তালুকদার এখন সমগ্র চট্টগ্রাম বিভাগে প্রসিদ্ধ ৪৫টি কাচ্চি বিরিয়ানির রেস্টুরেন্টের মালিক। তার ছোট অ’পর এক ভাইকে সাথে নিয়ে সমগ্র চট্টগ্রামে গড়েছেন কাচ্চি বিরিয়ানির সম্রাজ্য।
দুবেলা খাবার খরচের জন্য দৈনিক মাত্র ২৫ টাকার বিনিময়ে চট্টগ্রামের নিউমা’র্কে’টে একটি টেইলারিং শপে কাজ শুরু করেন। সময় পেরিয়েছে মাত্র ২২ বছর।
বর্তমানে ৩৮ বছর বয়সী হাজী শাহাবুদ্দীন তালুকদার তার হার না মানা জীবনের গল্প শুনিয়েছেন রাইজিংবিডির কাছে।হাজী মো. শাহাবুদ্দীন তালুকদার জানান, তার দেশের বাড়ি বরিশাল জে’লার মুলাদি ইউনিয়নে। তার এক এক মামা চট্টগ্রামে টেইলার মাস্টার হিসেবে কাজ করতেন।
সেই সুবাদে ১৫/১৬ বছর বয়সে চট্টগ্রামে এসে কোন কাজ শেখা বা কর্মজীবন শুরু করার পরিকল্পনা করেন। ২০০১ সালে তিনি বাবার কাছ থেকে মাত্র ৬০ টাকা নিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসেন। চট্টগ্রামে এসে তিনি মামা’র সহায়তায় চট্টগ্রামের নিউ মা’র্কে’টের সৌদিয়া বোরকা হাউজে নামের একটি দোকানে টেইলারিং কাজ শিখতে শুরু করেন। কোন ধরনের মাসিক বেতন ছাড়া দৈনিক খাবার খরচ বাবদ ২৫ টাকার বিনিময়ে সৌদিয়া বোরকা হাউজে টানা দেড় বছর কাজ শিখেন তিনি। এই দেড় বছর সময়ে শুধুমাত্র আলু ভর্তা আর ডাল দিয়েই ভাত খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন মাসের পর মাস।
হাজী শাহাবুদ্দীন তালুকদার বলেন, টেইলারিং শপে কাজ শিখতে শিখতেই স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলাম। আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম এই টেইলারিং-এর কাজ দিয়ে আমা’র কিছুই হবে না। আমাকে নতুন কিছু করতে হবে। দেড় বছর টেইলারিং শপে কাজ শেখার পর একই মা’র্কে’টের ই’রানী বোরকা হাউস নামের অ’পর একটি বোরকার দোকানে মাসিক ২৫০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করি। এখানে কাজ করতে করতে বেতনও কিছু বৃদ্ধি পায়। কিছু টাকাও সঞ্চয় হয়।
এভাবে টানা ৬ বছর চাকরি করে নিজের কিছু সঞ্চয় আর স্বজনদের কাছ থেকে ধারকর্জ করে ২০০৮ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ আখতারুজ্জামান সেন্টারে নিজেই একটি বোরকার দোকান শুরু করেন। এর তিন মাসের মা’থায় চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার এলাকায় কিং অব পরীস্থান নামক মা’র্কে’টের নিচে একটি ছোট্ট বিরিয়ানির দোকান শুরু করেন। নাম দেন ‘হাজী বিরিয়ানি’। এক লাখ টাকা বিনিয়োগে শুরু করা হাজী বিরিয়ানির এই দোকান রীতিমতো কপাল খুলে দেয় হাজী শাহাবুদ্দীন তালুকদারের।
স্বাদের ভিন্নতা ও খাবারের বৈচিত্রতায় শাহাবুদ্দীনের বিরিয়ানির চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকায় ঢাকা থেকে ছোটভাই মিন্টু তালুকদারকেও নিয়ে আসেন চট্টগ্রামে। দুই ভাই মিলে শুরু করেন বিরিয়ানির ব্যবসা। সেই ২০০৮ সালের পর থেকে এই দুই ভাইকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বছর বছর প্রসিদ্ধ আর সমৃদ্ধ হতে থাকে হাজী শাহাবুদ্দীনের বিরিয়ানির ব্যবসা। বর্তমানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ সমগ্র চট্টগ্রাম বিভাগে হাজী শাহাবুদ্দীন তালুকদার ও হাজী মিন্টু তালুকদারের রয়েছে ৪৫টি কাচ্চি বিরিয়ানির রেস্টুরেন্ট। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীতেই আছে ২২টি বিরিয়ানির রেস্টুরেন্ট।
হাজী শাহাবুদ্দীন তালুকদার ও হাজী মিন্টু তালুকদারের মালিকানাধীন মোট ৪টি ব্র্যান্ডে কাচ্চি বিরিয়ানির রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এগুলো হলো কাচ্চি ডাইন, কাচ্চির সম্রাট, হাজী বিরিয়ানি, হাজী কাচ্চি ঘর। ৪টি ব্র্যান্ড নামে অর্ধশত রেস্টুরেন্টে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করে দিয়েছেন এই দুই ভাই।তাদের রেস্টুরেন্টগুলোতে যেসব খাবার বিক্রি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো কাচ্চি বিরিয়ানি, পোলাও, খিচুড়ি, আখনি বিরিয়ানি ইত্যাদি। এছাড়া বাদাম শরবত, বোরহানি, ফিরনি, জর্দাসহ নানা পদের খাবার রয়েছে রেস্টুরেন্টে।
একেবারে অ’ভিজাত শ্রেণির মানুষদের পাশাপাশি সব শ্রেণিপেশার মানুষের খাবার ও পরিবেশ উপযোগী বিরিয়ানির রেস্টুরেন্ট গড়ে তুলেছেন হাজী শাহাবুদ্দীন তালুকদার। তার রেস্টুরেন্টগুলোতে দৈনিক ২শ থেকে ৩শ ডেক পর্যন্ত বিরিয়ানি তৈরি ও বিক্রি হয়। দিনের খাবার দিনেই বিক্রি হয়। বাসি কোনো খাবার বিক্রি করেন না তারা। বিক্রি অবশিষ্ট থাকলে সেগুলো দান করে দেন। এছাড়া তার প্রতিটি রেস্টুরেন্টের উদ্বোধন শুরু হয় এতিমখানার ছাত্রদের কাচ্চি বিরিয়ানিতে আপ্যায়নের মধ্যে দিয়ে।
তার এই সাফল্যের কারণ জানাতে গিয়ে হাজী শাহাবুদ্দীন তালুকদার বলেন, আমা’র সততা, কঠোর পরিশ্রম এবং স্বপ্নের প্রতি অবিচল থেকে কাজ করে যাওয়াই আমা’র শক্তি। আমি রাত-দিন পরিশ্রম করেছি। এখনো করে যাচ্ছি। এই পরিশ্রমের ফলে প্রতিমাসেই দেশের কোন না কোনস্থানে আমা’র নতুন রেস্টুরেন্ট উদ্বোধন হচ্ছে।ভবিষ্যত পরিকল্পনা স’ম্পর্কে তিনি জানান, দেশ ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও হাজী বিরিয়ানি, হাজী কাচ্চি ঘর কিংবা কাচ্চির সম্রাট’কে নিয়ে যেতে চাই। বর্তমানে দুবাইতে কাচ্চির সম্রাট চালু করার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান।ব্যক্তিগত জীবনে দুই ছে’লে ও এক মে’য়ে রয়েছে তার। দুই ছে’লেই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। একমাত্র মে’য়ে এখনো পড়াশোনা শুরু করেনি।