সৌদিতে ‘কাফালা আইনে’ পরিবর্তনই কি যথেষ্ট?

প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে কাফালা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সৌদি আরব। ফলে শ্রমিকরা স্বাধীনভাবে কাজ পরিবর্তন করতে পারবেন। চাইলে দেশেও ফিরে যেতে পারবেন। এতে সৌদি আরবে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মীরা কতটা উপকৃত হবেন? কাফালা শব্দটি আরবি ‘কফিল’ শব্দ থেকে এসেছে। কফিল মানে মালিক। কাফালা আইন অনুযায়ী, প্রবাসী কর্মীরা সেখানে একজন মালিকের অধীনে কাজ করতে যান। তার অনুমতি ছাড়া নতুন কোনো জায়গায় কাজ নেয়া বা দেশে ফেরা বেআইনি।

এমনকি নির্যাতনের শিকার হলেও না। নির্যাতনের শিকার হয়ে কেউ পালিয়ে গেলে ওই কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। কেউ মারা গেলে মালিকের অনুমতি ছাড়া দেশে লাশও পাঠানো যায় না।এই আইনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনসহ নানা মহল থেকে অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছিল। অবশেষে সৌদি আরবের জনশক্তি উপমন্ত্রী আব্দুল্লাহ বিন নাসের আবুথুনাইন বুধবার রিয়াদে কাফালা নীতিতে পরিবর্তন আনার কথা জানিয়েছেন। আগামী মার্চ মাস থেকে তা কার্যকর হবে।

সেটা হলে সৌদি আরবে প্রবাসী কর্মীরা মালিকের অনুমতি ছাড়াই স্বাধীনভাবে তাদের কাজ বা চাকরি পরিবর্তন করতে পারবেন। মালিক কোনো বাধা দিতে পারবেন না। আর কেউ চাইলে দেশেও ফিরে যেতে পারবেন। সৌদি মন্ত্রী বলেন, ‘এর মাধ্যমে আমরা একটি আকর্ষণীয় শ্রমবাজার গড়ে তুলতে চাই, এখানে কাজের পরিবেশকে উন্নত করতে চাই।আরো জানানো হয়েছে, প্রবাসী কর্মীরা মালিকের অনুমতি ছাড়াই সেখানকার সরকারি সেবার জন্য আবেদন করতে পারবেন।

তারা স্বাধীনভাবে সৌদি আরবের ভেতরে ও বাইরে ভ্রমণ করতে পারবেন। তাদের নিয়োগের চুক্তি ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হবে।নতুন এই পদ্ধতি চালু হলে বাংলাদেশের কর্মীরাও সেখানে সুবিধা পাবেন বলে মনে করেন ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান। তবে আইনটি কার্যকর হওয়ার আগে আসলে বলা সম্ভব নয় যে কতটা সুবিধা প্রবাসী কর্মীরা পাবেন।

সৌদি আরবে এখন বিভিন্ন দেশের প্রায় ১ কোটি প্রবাসী কর্মী রয়েছেন। তার মধ্যে ২০ লাখ বৈধ বাংলাদেশি আছেন। আর বাংলাদেশিদের মধ্যে তিন লাখ নারী কর্মী, যারা গৃহকর্মী হিসেবে দেশটিতে কাজ করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে প্রতিমাসে বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৪০ হাজার কর্মী যান সৌদি আরবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১০ হাজারের মতো বাংলাদেশি নাগরিক ডিপোর্টেশন সেন্টারে আছেন। তার অধিকাংশই সৌদি আরবে। ২০১৪ সালে আট লাখ বাংলাদেশি সেখানে সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছেন।শরিফুল হাসান বলেন, ‘গৃহকর্মী হিসেবে যারা সৌদি আরবে কাজ করেন তারা ৯ ধরনের কাজ করেন মালিকের বাড়িতে। কাফালা পদ্ধতির পরিবর্তন হলে যে রাতারাতি তাদের অবস্থার উন্নতি হবে তা বলা যায় না। আগে তাদের পালিয়ে আসতে হত। আর পালিয়ে আসার পর তাদের বিরুদ্ধে চুরির মামলা হত।

এখন হয়তো কেউ কাজ না করলে চলে আসতে পারবেন। কিন্তু নির্যাতন পরিস্থিতি বন্ধ করতে হলে আইনে আরো পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশ সরকারকেও দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ সেখানে থেকে মামলা করে ক্ষতিপূরণ আদায় করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’ব্র্যাকের অভিবাসন বিভাগের হিসাব মতে, গত চার বছরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ৪৭৩ জন বাংলাদেশি প্রবাসী নারী কর্মী মারা গেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরবে মারা গেছেন ১৭৫ জন। ৮১ জন নারী কর্মী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আত্মহত্যা করেছেন। তার মধ্যে সৌদি আরবে ৫১ জন। গত দুই বছরে সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা ৬৩ জনকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৮ জনই নারী।

শরিফুল হাসান বলেন, ‘কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলকে সামনে রেখে এরই মধ্যে তাদের কাফালা পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। তারও প্রভাব পড়ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। সৌদি আরব ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক দেশ এই পবির্তনে এগিয়ে আসছে।তবে একটি সংকটও সামনে আসতে পারে। কাতার ও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো অনেক দেশে প্রবাসীদের জন্য শ্রমবাজার সংকুচিত হতে পারে। বিশ্বের পরিবর্তিত অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ওই দেশগুলো তাদের নিজেদের দেশের কর্মী বাড়াতে চাইছে।’

পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হলেও কাফালা বহাল থাকছে। কিন্তু অভিবাসন বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, নির্যাতন বন্ধ করতে হলে পুরো কাফালা পদ্ধতিই বাতিল করা প্রয়োজন। তা না হলে কর্মীদের একজন মালিকের অধীনেই যেতে হবে সেখানে। আর এই আইন পরিবর্তন হলে গৃহকর্মীরা সুযোগ পাবেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়।মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ‘স্বাধীনভাবে কাজ পরিবর্তন বা দেশে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া একটা অগ্রগতি। কিন্তু সৌদি আরবে প্রবাসী কর্মীদের শ্রমঘণ্টা ও বেতনের কোনো আইন নেই। ফলে কফিল বা নিয়োগকারী তাকে তার ইচ্ছে মতো কাজ করায়, মজুরি দেয়, নির্যাতন করে। এটার জন্য শ্রম আইন সেখানে চালু হওয়া দরকার।’

তিনি বলেন, ‘নির্যাতন হলে তার প্রতিকার, ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা এই বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এজন্য বাংলাদেশ সরকারেরও সৌদি আরবের সাথে আলোচনা শুরু করা উচিত।’ তার মতে, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির অধীনে নিয়োগ হতে পারে, তবে তা সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় আইনের অধীনে করার বিধান করতে হবে।