১৯ বছর আগে মির্জা সাখাওয়াত হোসেন শান্তর সঙ্গে বিয়ে হয় ফাতেমা নাসরিনের। তিনি সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের ভাতিজি। তার স্বামী সাখাওয়াত ২১তম বিসিএসের একজন ক্যাডার। সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন পিডব্লিউডিতে। এই বিসিএস ক্যাডার স্বামীর নির্মমতার বলি হন ফাতেমা। যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার এই নারী যেভাবে তার স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন সে বিবরণে গা শিউরে ওঠে।
এ ঘটনায় নিহতের স্বজনের করা হত্যা মামলায় সম্প্রতি চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। চার্জশিটে উঠে এসেছে নির্মম নির্যাতনের করুণ চিত্র, যা শুনলে যে কারও চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ফাতেমা নাসরিন (৪৫) ও মির্জা সাখাওয়াত হোসেন শান্ত (৪৯) দম্পতির ১৮ বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তানও আছে। বিয়ের পর থেকেই বিভিন্ন সময় স্ত্রীর কাছে যৌতুক দাবি করে আসছিলেন সাখাওয়াত। ফাতেমা যেন ঠাকুরগাঁওয়ে তার পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করে এক কোটি টাকা দেন এজন্য চাপও দিতেন তিনি। ওই পৈতৃক বাড়িতে আরও অনেকের অংশ রয়েছে। তাই একা বিক্রি করা যাবে না বলে জানান ফাতেমা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করেন সাখাওয়াত।
জানা গেছে, গত ৮ মার্চ শবে বরাতের রোজা রেখে সন্ধ্যায় ইফতার তৈরি করছিলেন ফাতেমা। ওই দিনও যৌতুকের টাকার জন্য সাখাওয়াত তার মোহাম্মদপুরের বাসায় ফাতেমাকে চাপ দিতে থাকেন। এতে প্রতিবাদ করলে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে অমানবিকভাবে ফাতেমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ও মাথায় গুরুতর আঘাত করেন সাখাওয়াত। এসময় প্রাণভিক্ষা চেয়েও পাননি ফাতেমা।
স্বামীর অমানবিক মারধরে ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এ ঘটনায় করা মামলায় স্বামী সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে ঘটনার সত্যতা পেয়ে সম্প্রতি চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন। চার্জশিটে এমন কথা উল্লেখ করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে মামলার বাদী আরজিনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, যৌতুকের জন্য আমার বোন ফাতেমাকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন তার স্বামী মির্জা সাখাওয়াত হোসেন। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। যাতে আর কাউকে যৌতুকের জন্য খুন হতে না হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মামলার তদন্তে নেমে ঘটনার সত্যতা পেয়ে আসামি মির্জা সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছি। চার্জশিটে সাক্ষী করা হয়েছে ২০ জনকে। আসামির বিরুদ্ধে পঞ্চগড়েও একটি যৌতুক মামলা চলমান। ওই মামলায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পেয়ে চার্জশিট দাখিল করেন সেখানকার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
মামলার চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, সার্বিক পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, মামলার বাদী আরজিনা বেগমের (৫২) ছোট বোন ভিকটিম ফাতেমার সঙ্গে আসামি সাখাওয়াত হোসেন শান্তর ২০০৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবনে তাদের একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে। বিয়ের পর থেকেই মির্জা সাখাওয়াত হোসেন শান্ত তার স্ত্রী ফাতেমার কাছে যৌতুক দাবি করে আসছেন।
আসামি বিভিন্ন সময় ঠাকুরগাঁও শহরে ভিকটিমের পৈতৃক জমি বিক্রি করে এক কোটি টাকা যৌতুক এনে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। ফাতেমার পৈতৃক জমিতে পরিবারের সবার অংশ থাকার বিষয়টি বিবাদীকে জানালে বিবাদী ফাতেমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন করতে থাকেন। সন্তান ও সংসারের কথা ভেবে ফাতেমা বিবাদীর সব অত্যাচার সহ্য করে আসছিলেন। এরপর দিন দিন বিবাদীর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে গেলে ফাতেমা নিজে বাদী হয়ে সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে পঞ্চগড় সদর থানায় যৌতুক আইনে একটা মামলা করেন। ঘটনার সত্যতা পেয়ে সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। সাখাওয়াত সংসার করার শর্তে আদালত থেকে জামিন নেন। জামিনে বের হয়ে ফের যৌতুকের এক কোটি টাকার জন্য পুনরায় ফাতেমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকেন।
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, ভিকটিম ফাতেমা অত্যন্ত ধার্মিক ও পরহেজগার ছিলেন। পক্ষান্তরে আসামি একজন চরিত্রহীন, লম্পট, বাটপার এবং যৌতুকলোভী মানুষ। তিনি তার প্রথম স্ত্রী ফাতেমার অনুমতি ছাড়াই জৈতুন বেগম নামে একজনকে বিয়ে করেন। পঞ্চগড় জেলার সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচারাধীন মামলায় আসামি মির্জা সাখাওয়াত হোসেন শান্ত প্রথম স্ত্রী ফাতেমার সঙ্গে ঘর-সংসার করবে শর্তে জামিন নিয়ে ঢাকার বর্তমান ঠিকানায় বসবাস শুরু করেন।
ঘটনার দিন চলতি বছরের ৮ মার্চ ফাতেমা শবে বরাতের রোজা রেখেছিলেন। ওইদিন মোহাম্মদপুর থানার হুমায়ুন রোডে সাখাওয়াতের ভাড়া বাসায় অবস্থানকালে ইফতার বানানোর জন্য রান্নাঘরে ছিলেন ফাতেমা। মির্জা সাখাওয়াত হোসেন শান্ত তার পঞ্চগড়ের মির্জা বোর্ডিং নামের আবাসিক হোটেল বড় করার জন্য বিভিন্ন সময়ে দাবি করা যৌতুকের টাকা চাইলে ভিকটিম প্রতিবাদ করলে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। এসময় তাদের চিৎকার শুনে পাশের রুমে থাকা ভিকটিমের মেয়ে এবং ফুফাতো বোন ও তার মেয়ে বের হয়ে আসেন।
ঝগড়ার একপর্যায়ে বিবাদী ভিকটিমকে এলোপাতাড়ি কিল, ঘুসি ও লাথি মারতে মারতে রান্নাঘরের সামনের মেঝেতে ফেলে দেন। পরে বিবাদী রান্নাঘর থেকে ধারালো বঁটি এনে ফাতেমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে উদ্যত হলে বাদীর বোনের মেয়ে ও ভিকটিমের ফুফাতো বোন বিবাদীর হাত থেকে বঁটি নিয়ে নেন। ফাতেমার মেয়ে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করে ঘটনার বিষয় জানায়। তখন একপর্যায়ে আসামি ফাতেমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পা দিয়ে মাথায় মারতে থাকেন এবং রান্নাঘর থেকে মসলা বাটার বাটনা এনে সেটা দিয়ে ভিকটিমের মাথায়, হাতে ও পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করেন। আঘাতের ফলে ভিকটিমের মাথা, হাতে ও পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান থেঁতলে রক্তাক্ত জখম হয়। আসামি তখন ভিকটিমের মৃত্যু হয়েছে ভেবে নিজের রুমে চলে যায়।
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, এরপর একই বিল্ডিংয়ে বসবাসরত বাদীর ছোট ভাই মহিউদ্দিন মোহাম্মদ, মাসউদুর রহমান ও তার স্ত্রীসহ আশপাশের লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে রক্তাক্ত ফাতেমাকে উদ্ধার করে প্রথমে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক ফাতেমাকে আগারগাঁওয়ের নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে রেফার্ড করেন। সেখানে ফাতেমার সিটিস্ক্যান করানো হয়। রিপোর্ট দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, ফাতেমার মাথার খুলির পেছন সাইডের হাড় ভেঙে গেছে এবং মস্তিষ্কের উভয় পাশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। চিকিৎসক দ্রুত তার অপারেশন করেন। কিন্তু সেখানে তিনি গত ১৭ মার্চ রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় ১৮ মার্চ ভিকটিমের বড় বোন আরজিনা বেগম বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করেন। মামলার পর সাখাওয়াতকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালত তার তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সাখাওয়াত। বর্তমানে তিনি কারাগারে।
তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং আসামির পিসি/পিআর পর্যালোচনায় আরও জানা যায়, মামলার এজাহারনামীয় গ্রেফতার আসামি মির্জা সাখাওয়াত হোসেন শান্ত একজন লোভী প্রকৃতির মানুষ। তিনি লোভের বশবর্তী হয়ে একজন সরকারি কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তার স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত যৌতুকের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন। অপরপক্ষে মামলার ভিকটিম ফাতেমা একজন পরহেজগার এবং ধার্মিক ছিলেন। তিনি সংসার রক্ষা এবং সুখের জন্য প্রতিনিয়ত আসামির নির্যাতন সহ্য করতেন। তিনি তার স্বামীর প্রতি অনুগত ছিলেন। কিন্তু আসামি এতটাই পেশাদার নির্যাতনকারী ছিলেন যে, তার স্ত্রী শবে বরাতের রোজা রেখে রান্নাঘরে ইফতার তৈরিকালে নির্যাতনের সময় প্রাণভিক্ষা চেয়েও পাননি। আসামি মির্জা সাখাওয়াত হোসেন শান্তর বিরুদ্ধে বাদীর আনীত অভিযোগ ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী ২০০৩) এর ১১ (ক) ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, সন্তান ও সংসারের কথা চিন্তা করে এসব অত্যাচার সহ্য করে আসছিলেন ফাতেমা। দিন দিন সাখাওয়াতের নির্যাতন বেড়ে যাওয়ায় সহ্য না করতে পেরে জানুয়ারি মাসে পঞ্চগড় সদর থানায় নারী ও নির্যাতন আইনে একটি মামলা করেন তিনি। ওই মামলায় সাখাওয়াত গ্রেফতারও হয়েছিলেন। পরে জামিনে বের হয়ে আবারও যৌতুকের টাকার জন্য তাকে চাপ দিতে থাকেন। সর্বশেষ যৌতুকের কারণে স্বামীর নির্মমতার বলি হতে হয় ফাতেমাকে।