বড় মেয়ের দাফন, ছোট মেয়ে আইসিইউতে, পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ

তানভীরুল ইসলাম: পিতার কাঁধে সন্তান লাশ নাকি পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু। টগবগে সন্তানের এই লাশের ভার কাঁধে তুলে নিয়ে তাকে কবরে রেখে আসা যে কতটা দুঃসহ যন্ত্রণার, সেটি একমাত্র তিনিই বুঝতে পারবেন, যিনি তার সন্তানকে হারিয়েছেন। বিষয়টি আরও বেদনাবিধুর হয়, যখন একটি সন্তানকে মৃত্যুর কাছাকাছি রেখে অন্য আরেকটি সন্তানকে কবরে শায়িত করে আসেন বাবা নামক নিথর একটি পাথর। ঠিক এমনটিই ঘটেছে আলমগীর হোসেনের ক্ষেত্রে।

ঠিকাদার আলমগীর হোসেনের ঘর আলো করে রাখতো আট বছর বয়সী আফিয়া আঞ্জুম ও ছয় বছর বয়সী তাসনিয়া তাসনিম। তবে তাদের সেই আলোকিত ঘরে নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। ডেঙ্গু কেড়ে নিয়েছে আফিয়া আঞ্জুমকে। আর ছোট মেয়ে তাসনিয়াও সেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে।

দুই সন্তান আর স্বামী-স্ত্রী মিলে চারজনের পরিবার নিয়ে রাজধানীর ৬০ ফুট এলাকার একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন আলমগীর হোসেন। তাদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালিতে।

গত ১০ সেপ্টেম্বর বড় মেয়ে আফিয়ার জ্বর আসে, এরপরই হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করা হলে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। দুইদিন পরই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ছোট মেয়ে তাসনিয়াও। চিকিৎসার জন্য দ্রুত হাসপাতালে গেলেও অল্প সময়ের ব্যবধানে না ফেরার দেশে পাড়ি জমায় আফিয়া। আলাপকালে এমন নির্মম দুঃসময়ের বর্ণনা দেন আলমগীর হোসেন।

তিনি বলেন, একটা মেয়েকে আমি এর মধ্যেই ডেঙ্গুতে হারিয়েছি। ছোট মেয়েটাও এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) ভর্তি। এই ডেঙ্গু এক মেয়েকে কেড়ে নিয়েছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার আর্জি অন্তত ছোট মেয়েটাকে যেন তিনি আমার কোলে ফিরিয়ে দেন। এই মেয়েটার কিছু হলে আমার আর বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন থাকবে না।

আলমগীর হোসেন বলেন, ১০ সেপ্টেম্বর বড় মেয়েটার জ্বর আসে। ১২ সেপ্টেম্বর তাকে নিয়ে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে চলে আসি। প্রথমে হাসপাতালের বেডে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। পর দিন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এক পর্যায়ে বড় মেয়ে আফিয়া শক সিন্ড্রোমে চলে যায়, তার রক্তচাপ কমে যায়।

তিনি বলেন, এরপর হাসপাতাল থেকে বলা হয় পিআইসিইউয়ে নিতে। চিকিৎসকরা এক পর্যায়ে নরমগ্লোবিন নামে ইনজেকশনের ব্যবস্থা করতে বলেন। তবে অনেক খুঁজেও যখন ইনজেকশন পাইনি, তখন চিকিৎসকরা মেয়েকে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে যায়। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় আফিয়া মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে।

তিনি বলেন, ছোট মেয়েটাকে হাসপাতালে ভর্তি রেখেই শনিবার বড় মেয়ের লাশ নিয়ে যাই গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালিতে। এক মেয়েকে হাসপাতালের বিছানায় রেখে আরেক মেয়েকে দাফন করে এসেছি।

তিনি আরও বলেন, সিরাজগঞ্জ থেকে এসে দেখি যে ছোট মেয়েটারও শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ডাক্তার এসে বলে তাকেও জরুরিভিত্তিতে পিআইসিইউয়ে নিতে হবে। আমি চিকিৎসককে বলেছি এক মেয়েকে হারিয়েছি, সেই বেডেই আমার ছোট মেয়েকে রাখার ব্যবস্থা করে দিন। এরপর থেকে বড় মেয়ের সেই পিআইসিইউ বেডেই চিকিৎসা নিচ্ছে তাসনিয়া।

তিনি বলেন, আফিয়াকে হারিয়ে আমার পরিবারে ঘোর অমানিশা নেমে এসেছে। সামান্য ডেঙ্গুতে আমাকে আমার আদরের সন্তানকে হারাতে হবে কখনও কল্পনাও করিনি। বড় মেয়েকে হারানোর পর আমার স্ত্রীর অবস্থাও খুবই খারাপ হয়ে গেছে। আমি নিজেই তো বিষয়টি মেনে নিতে পারছি না, তাকে আমি কী বুঝাবো? সে নিজের মতোই কান্নাকাটি করে, নিজের মতোই শান্ত হয়।

দুই মেয়ের এক মেয়েকে ফেরাতে পারেননি। এখন আরেক মেয়েকে যেন সৃষ্টিকর্তা কেড়ে না নেন, সেই প্রার্থনাই করে যাচ্ছেন আলমগীর হোসেন।

ছোট মেয়ের ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা চিকিৎসক কী জানিয়েছে, জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, ডাক্তার বলেছে শারীরিক অবস্থা এখন কিছুটা উন্নতির পথে। হয়তো আরও দুয়েকদিন তাকে পিআইসিইউতেই থাকতে হবে। কিন্তু যতদিন আমার মেয়েকে আমি কোলে না নিতে পারছি, আমি কোনো আশ্বাসই মানতে পারছি না। তাকে যদি সুস্থ অবস্থায় কোলে নিতে পারি, তাহলেই হয়তো বড় মেয়ের কষ্ট কিছুটা ভুলে থাকা যাবে।

পিআইসিইউতে দায়িত্বরত শিশু হাসপাতালের রেজিস্ট্রার ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ মশিউর রহমান বলেন, ওনার একটি মেয়ে ডেঙ্গুতে মারা গেছে, আরেকটি মেয়ে আমাদের পিআইসিইউতে ভর্তি আছে। বাবা হিসেবে ওনার অবস্থান থেকে বিষয়টি খুবই কষ্টদায়ক। ছোট মেয়েটা এখন অনেকটাই ভালোর দিকে। আশা করছি শনিবার বা পরশু তাকে আমরা সাধারণ বেডে নিয়ে আসতে পারব।

ডেঙ্গু প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের পিআইসিইউতে ভর্তি অধিকাংশ রোগীই ডেঙ্গু আক্রান্ত। এখানে সিট ফাঁকা পাওয়া অনেকটাই কঠিন। তবে সাধারণ বেডে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য শয্যা প্রস্তুত আছে। দৈনিক ২০/২৫ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী আমাদের হাসপাতালে আসছে। বর্তমানে হাসপাতালে শতাধিক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা সিটিতে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭৬ হাজার ৬২২ জন। এর মধ্যে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৬ হাজার ৫০৫ জন, ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৬ হাজার ৯৫ জন, ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু চিকিৎসা নিয়েছে ৬ হাজার ৩৮৮ জন। এ ছাড়াও ১৬ বছর থেকে ২০ বছর বয়সী শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ৮ হাজার ৫১০ জন।

অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ঢাকার বাইরেও শিশুদের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার হার আশঙ্কাজনক। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে শূন্য থেকে ২০ বছর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ২৯ হাজার ২২৭ জন। তাদের মধ্যে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সী ৩ হাজার ৬৯০ জন, ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী ৪ হাজার ১২৯ জন, ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু ৬ হাজার ৮৪৩ জন এবং ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সী রয়েছে ১৪ হাজার ৫৬৫ জন।-ঢাকা পোস্ট