ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে বহুল আলোচিত ঈদের দিনে নামাজ পড়াকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের মামলার ঘটনা নতুন মোড় নিয়েছে। উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের গোহাইলবাড়িতে গত বছরের ৩রা মে মঙ্গলবার দুইজন খুন হন। উক্ত খুনের মামলার বাদী মোস্তফা জামান সিদ্দিকীই এখন হত্যা মামলার প্রধান আসামী। ফরিদপুর আদালতে মামলাটি নিহত খায়রুল ইসলামের স্ত্রী নাসিমা বেগম বাদী হয়ে দীর্ঘ ১৭ মাস পরে গত ১২/১০/২০২৩ ইং রোজ বৃহস্পতিবার দায়ের করেন। যে মামলার নম্বর সি আর ৪৮৯/২৩। যারা কাইজে সংঘাতে নিহত হন তারা হলেন চর দৈত্ত্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দা আকিদুল ইসলাম ও খায়রুল ইসলাম। মামলার বাদী হওয়ার কথা নিহতদের পরিবার কিংবা স্বজনের মধ্যে কেউ। তারা না হয়ে কেন মোস্তফা জামান সিদ্দিকী বাদী হলেন। এখানেই শুরু নাটকের৷ ০৭/০৫/২০২২ তারিখে বোয়ালমারী থানায় যে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছিল(মামলা নং ০৩, জি আর ৮৯/২২) তার সংবাদদাতা ও বাদী হলেন একই গ্রামের মোস্তফা জামান সিদ্দিকী। তিনি নিহতের পরিবার ও স্বজনের কেউ নন। নিহতদের স্বজনের মধ্যে মৃত আকিদুলের পরিবার ও খায়রুলের স্ত্রী বোয়ালমারী থানায় মামলা করতে গেলে মোস্তফা জামান সিদ্দিকী তাদের জানান মামলা তিনি করেছেন তাই আর মামলা করতে হবে না। জোড়া খুনের মামলায় যাদের আসামী করেছেন মোস্তফা তাদের সংখ্যা ৮১ জন৷ যা দেখে নিহতের স্ত্রী ও পরিবারের চোখ কপালে উঠে যায়। যারাই হত্যা করেছেন তারাই বাদী হলেন কেমনে? আবার যাদের কেউ এই হত্যার সাথে একেবারেই জড়িত নন তারাও আসামী। পরবর্তীতে চার্জশিটে পুলিশ আসামি করেছে ১০৮ জনকে। তাহলে ১৭ মাস পরে নিহতের পরিবারকে কেন আবার হত্যা মামলা করতে হলো?
মামলার বাদী ই কেন প্রধান আসামী হলেন৷ আর প্রথম মামলার আসামি ১০৮ হলেও যারা নিহত হয়েছিল তাদের পরিবারের করা মামলায় আসামির সংখ্যা মাত্র ১৫ জন কেন? এই নানা প্রশ্নের উত্তর পাবেন মামলার নথিতে। সি আর মামলায় নাসিমা বেগম উল্লেখ করেছেন সব বিষয়। জি আর মামলার বাদী মোস্তফা ই হত্যা করেছেন স্বামীকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন নাসিমা। অথচ মোস্তফা তাদের দলনেতা। এইবার আসি মূল ঘটনায়…. ঘোষপুর ইউনিয়নে দুইটি গ্রুপ আছে। একটি গ্রুপ মোস্তফা জামান সিদ্দিকির অপরটি হলো ফারুক চেয়ারম্যানের। চর দৈত্তরকাঠি গ্রামে পাশাপাশি দুইটি ঈদগাহ আছে। একটি ঈদগাতে মোস্তফা জামান সিদ্দিকির লোকজন নামাজ পড়ে। অপরটিতে মোল্যারা নামাজ পড়ে। কিন্তু গত ০৩/০৫/২২ তারিখে বৃষ্টি হওয়ার কারণে ঈদের নামাজ মসজিদে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মোস্তফা জামান সিদ্দিকির ঈদগাতে লোকজন কম হবে বলে মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে বাধা দেয়। আমজাদসহ আরও অনেকে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে জালাল মাতবরের ছেলে আরশসহ বেশ কিছু লোকজন মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। নামাজ পড়তে গেলে কথা কাকাটি হয়। পরবর্তিতে নামাজ পড়তে না দিলে আমজাদসহ আরও অনেকে গোহাইলবাড়ী বাজার জামে মসজিদে নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষ করে বাড়ীতে আসার পথে দেখতে পায় মোস্তফা জামান সিদ্দিকিসহ ও তার লোকজন ঢাল শোরকি নিয়ে তার বাবা নূরুল হককে মারধর করছে এবং বাড়ী ঘেড়াও করে রেখেছে। আমজাদ মাস্টার বাড়ীতে ঢুকতে না পেরে বিষয়টি ফারুক চেয়ারম্যানের লোকজনকে জানায়। ফারুক চেয়ারম্যানের লোকজন বিষয়টি জানতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে গোলমাল শুরু হয়। গোলমালে দুই জন মারা যায়। গোলমালে দুই পক্ষের মধ্যে কে বা কারা মারে সেই দিক বিবেচনা না করে মোস্তফা জামান সিদ্দিকি ২৫০ থেকে ৩০০ জনের আসামীর লিস্ট করে। আসামী করবে না বলে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে আসামী করে নাই । যারা টাকা দিতে পারে নাই তাদেরকে আসামীর লিস্টে রাখে। নিহত ব্যক্তির আপন লোক বাদী হতে গেলে মোস্তফা জামান সিদ্দিকি নিজে বাঁচার তাগিদে তাদেরকে বাদী হতে দেয় নাই । এই কর্মকান্ড নিজেই ঘটিয়ে নিহত ব্যক্তির কেউকে বাদী না করে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে মোস্তফা জামান সিদ্দিকি নিজে বাদী হয়ে ০৭/০৫/২২ তারিখে বোয়ালমারী থানায় ৮১ জন আসামী করে মামলা দায়ের করে। মামলা নাম্বার জি আর ৮৯/২২।
মামলা দায়ের হয়ে গেলে মোস্তফা জামান সিদ্দিকি ও তার লোকজনসহ আসামীদের বাড়ীতে ভাংচুর, লোটপাট, ৬০ টি গরু নিয়ে আসে। আমজাদের বাড়ীসহ দুটি বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরে ৬ জনকে বাদ দিয়ে ১০৮ জনের চার্জশীট আদালতে পাঠানো হয়। এই চার্জশীটের বিরুদ্ধে মোস্তফা জামান সিদ্দিকি না রাজী দিলে কোর্ট থেকে পিবআিইতে মামলা পুনরায় তদন্তে পাঠানো হয়। এই মামলায় নিরীহ ব্যক্তিদের আসামী করায় নিহত ব্যক্তির আপন লোক বিষয়টি বুঝতে পারে। তাই মোসাঃ নাছিমা বেগম বাদী হয়ে সঠিক বিচারের জন্য আদালতে মোস্তফা জামান সিদ্দিকি সহ ও ১৫ জনকে আসামী করে ১২/১০/২৩ তারিখে মামলা দায়ের করেছে। মামলার নাম্বার সি আর ৪৬৯/২৩। মামলায় নাসিমা বেগম যা নালিশী বর্ননা করেছেন তা নিচে নথিপত্র অনুযায়ী উল্লেখ্য ” মালিশের বিবরণ এই যে, আসামীগণ প্রচন্ড প্রভাবশালী, বিত্তশালী, সংঘবন্ধ, চাপাবাজ, হিংস্র, খুনি প্রকৃতির লোক হইতেছে। ১নং আসামী এলাকায় লাগলি করে এবং অন্যায় অপরাধ কর্মে নেতৃত্ব দেয়। ঘটনার দিন ঈদের নামাজের জামাতকে কেন্দ্র করে মসজিদে তালা দেওয়া নিয়া স্থানীয় লোকজনের সহিত তাহাদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। সেই কারণে আসামীরা ক্ষুব্ধ হইয়া এলাকার লোকজনের সহিত বিরোধে জড়াইয়া পড়ে।
আমার স্বামী মোঃ খায়রুল ইসলাম এবং ১/২নং সাক্ষীর পিতা আকিদুল ইসলাম আসামীদের কথামতো তাহাদের নেতৃত্বে ঈদের নামাজ পড়িতে না যাওয়ায় আসামীগণ ক্ষীপ্ত হইয়া আসামীরা আমাদের বসতবাড়ীতে অনধিকার প্রবেশ করিয়া আমার স্বামী খায়রুল ইসলাম ও প্রতিবেশি আকিদুল মোল্যাকে জোর পূর্বক টানা হেঁচড়া করিয়া লাল মিয়ার বসতবাড়ীর নিকট নিয়া যায় এবং সেখানে আসামীরা ধারালো অস্ত্র সস্ত্র ছ্যানদা লাঠি রামদা বেআইনী জনতাবদ্ধে সমবেত হইয়া ১নং আসামীর নেতৃত্বে ও হুকুমে সকল আসামীগণ আমার স্বামী খায়রুল ইসলামকে ঘর হইতে টানা হেঁচড়া করিয়া বাহিরে আনে এবং এলোপাথারী মারপিট শুরু করে। ১/২নং সাক্ষীর পিতা মারপিট ঠেকাইতে আসিলে আসামীগণ তাহাকেও বেধড়ক মারপিট শুরু করে ।আসামী মোস্তফা জামান সিদ্দিকি তাহার হাতে থাকা ধারালো ছ্যান দিয়া আমার স্বামী থায়রুল ইসলামকে হত্যা করার জন্যে মাথা লক্ষ্য করিয়া কোপ দিলে উক্ত কোপ খায়রুল ইসলামের পিঠের বামপাশে লাগিয়া মারাত্মক কাটা রক্তাক্ত জখম হয়। ২নং আসামী মামুন তাহার হাতে থাকা ধারালো রামদা দিয়া খুন করার উদ্দেশ্যে আমার স্বামী খায়রুল ইসলামের বাম পায়ের উরুতে কৌপ মারিয়া মারাত্মক রক্তাক্ত গুরুতর জখম করে। আসামী মাজেদ ফকির তাহার হাতে থাকা ধারালো ছ্যানদা দিয়া খুন করার উদ্দেশ্যে আমার স্বামী খায়ারুল ইসলামের মাথা লক্ষ্য করিয়া কোপ দিলে আমার স্বামী মাটিতে পড়িয়া যায়। তখন উক্ত কোপ আমার স্বামীর ডান পায়ের হাটুতে লাগিয়া গুরুতর রক্তাক্ত জখম হয়।
আসামী জুয়েল ফকির আমার স্বামী খায়রুল ইসলামকে হত্যা করার জনো পিঠের বামপাশে ধারালো রামদা দিয়া কোপ দেয়। তাহাতে গুরুতর রক্তাক্ত জখম হয়। আসামী মোস্তফা জামান সিদ্দিকি আকিদুল ইসলামকে হত্যার উদ্দেশ্যে রামদা দিয়া মাথার মাঝখানে কোপ দিলে আকিদুলের মাথার মগজ গড়গড় করিয়া রাস্তার উপর পড়িয়া যায়। আকিদুল মোল্লা মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করিতে থাকাবস্থায় আসামী বিল্লাল ধারালো ছ্যানদা দিয়া পেট লক্ষ্য করিয়া কোপ দিলে উক্ত কোপ আকিদুল মোল্যাকে ডান পায়ের হাটুতে লাগিয়া হাটু বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়। খায়রুল ইসলাম মাটিতে পড়িয়া গেলে আসামী গফ্ফার সেক তাহার হাতে থাকা রামদা দিয়া হত্যার উদ্দেশ্যে খায়রুল ইসলামকে কোপ দিলে উক্ত কোপ খায়রুল ইসলামের পিঠের বাম পাশে লাগিয়া মারাত্মক রক্তাক্ত গুরুতর জখম হয়। অন্যান্য সকল আসামীগণ খায়রুল ইসলাম ও আকিদুল মোল্যার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্যে তাহাদের হাতে থাকা লোহার রড ও লাঠি দিয়া পিটায়। আমরা ঢেকানোর চেষ্টা করিলে আসামীগণ আমাদেরকে গুরুতর ভীতি প্রদর্শণ করে এবং লাঠি দিয়া এলোপাথারী পিটায়।
অতঃপর আসামীগণ আকিদুলের পাটের গুদামে ঢুকিয়া লুটপাট করিয়া আনুমানিক ৫ লক্ষ টাকার পাট লুটপাট করিয়া নিয়া যায়। মানিত সাক্ষীগণ আগাইয়া আসিয়া আমার স্বামী খায়রুল ইসলাম ও জমি আকিদুল মোল্লাকে উদ্ধার করিয়া অটোবাইক যোগে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়। গোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্তৃব্যরত ডাক্তার আকিদুল মোল্লাকে মৃত্যু ঘোষণা করে। থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুরে রেফার্ড করিলে তাহাকে ফরিদপুর নিয়া রওনা তিলোতর বাজার নামক স্থানে মারা যান।
খবর পেয়ে বোয়ালমারী থানার পুলিশ আকিদুল মোল্লা ও খায়রুল ইসলামের সুরত হাল রিপোর্ট প্রস্তুত করিয়া ময়না তদন্তের জন্যে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে।
আকিদুল মোল্যার পরিবারের লোকজন এবং আমি স্বামী হত্যার বিচারের জন্যে বোয়ালমারী থানায় এজাহার করিতে গেলে ১নং আসামী আমাদেরকে বলে যে, মামলা হয়েছে। তোমাদের আর কোন মামলা করা লাগবে না। পরবর্তীতে জানিতে পারি আসামীগণ উক্ত ঘটনা হইতে নিজেদেরকে বাঁচানোর /আড়াল করার জন্যে তাহারা এলাকার নিরীহ নির্দোষ কিছু লোকজনের বিরুদ্ধে উক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে যাহা বোয়ালমারী থানার মামলা নং-০৩, তাং-০৭/০৫/২০২২, জি.আর ৮৯/২২, বোয়ালমারী। আসামীরা এলাকাবাসীর নিকট হইতে মামলার ভয় দেখাইয়া আসামী করিবে না এইরকম কথা বলিয়া মোটা অংকের চাঁদা আদায় করে। আমরা পরবর্তীতে তাহাদের বিরুদ্ধে মামলা করার উদ্যোগ নিলে উল্লেখিত আসামীগণ আমাদেরকে জীবনাশের হুমকি দিয়া জিম্মি করিয়া রাখে। আমরা অসহায়/বৈরী পরিবেশের কারণে যথাসময়ে মামলা করিতে পারি নাই। আসামীগণ এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করিয়া আমাদেরকে হুমকি দিয়া ভয় দেখাইয়া জিম্মি করিয়া নিরব করিয়া রাখিয়াছিল। সাক্ষীগণ ঘটনা জানে ও প্রমান করিবে 1
অতএব, প্রার্থনা হুজুর দয়া করিয়া আমার নালিশী মোকদ্দমাটি আমলে নিয়া আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়নার আদেশ দানে সুবিচারে মর্জি হয়