কান্না থামানো যাচ্ছে না মিরপুরে বাবা-মা-বোন হারানো শিশুটির!

বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন সাত মাস বয়সী হোসাইনের মা, বাবা ও বোন। আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসা দিয়ে তাকে পাঠানো হয়েছে বাসায়। সে এখন খালা লিমার তত্ত্বাবধানে আছে।

একটা দিন আগেও পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মায়ের কোলে ছিল সাত মাসের শিশু হোসাইন। আপন মনে খেলেছে, মায়ের সঙ্গে নিজের মতো করে খুনসুটি করেছে। কচি প্রাণ ভরে গেছে মায়ের সোহাগমাখা আদরে। আজ সেই মমতাময়ী মা নেই, স্নেহময় বাবা নেই, আদুরে বোনটিও নেই।

এক পরিবারের একান্ত আপন বলে কেউ নেই তার। শিশুটির ঠাঁই এখন অন্যের কোলে। ক্ষণে ক্ষণে কান্না ছাড়া আর কিছু নেই তার।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর মিরপুর-২ এলাকার ঝিলপার বস্তির বাসিন্দা আমেনা বেগমের (৪০) ঘরে দেখা মেলে হোসাইনের। শিশুটিকে কোলে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে মিরপুর মডেল থানার ঝিলপার বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তায় প্রবল বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ সময় অবৈধ সংযোগ দেওয়া বিদ্যুতের তার থেকে ওই পানি বিদ্যুতায়িত হয়। পানি ভেঙে যাওয়ার সময় হোসাইনের মা মুক্তা বেগম (২৫), বাবা মিজান (৩০) এবং বোন লিমা (৭) বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়।

এ সময় বাবার কোলে ছিল হোসাইন। বাবা বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হলে পানিতে ছিটকে পড়ে সে। তাকে পানি থেকে উদ্ধার করেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তারই সত্মামা আরিফ (২০)।

এদিকে হোসাইনের মা-বাবা ও বোনকে উদ্ধার করতে গিয়ে অনিক নামের এক পথচারী যুবকও বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হন। ওই যুবক এবং হোসাইনের মা-বাবা ও বোনকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন।

শিশুটিকে উদ্ধারের পর তৃতীয় লিঙ্গের বৃষ্টি, আমেনাসহ অন্য মহিলারা বাসায় নিয়ে গায়ে রসুন-তেল মাখান। পরে নাক দিয়ে রক্ত বের হলে দ্রুত তাকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানো হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে সকালে তাকে ছেড়ে দেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা। এর পর থেকে আমেনার কাছেই আছে হোসাইন।

আমেনা বলেন, ‘সাত মাসের এই বাচ্চার ভবিষ্যৎ কী, একমাত্র আল্লাহই জানেন! সে দুনিয়ার আলো-বাতাস বোঝার আগেই পরিবারের সবাইকে হারিয়ে এতিম হয়ে গেল। দুনিয়ায় আপন বলে আর কেউ রইল না তার।’

শিশু হোসাইনকে দেখতে এখন অনেকে আমেনার বাসায় ভিড় জমাচ্ছে। অচেনা মানুষ দেখলেই আঁতকে উঠছে শিশুটি। আর কান্না জুড়ে দিচ্ছে। তার বাঁ গোড়ালি সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। মায়ের দুধের বিকল্প হিসেবে তাকে ফিডারে করে দুধ খাওয়ানো হচ্ছে।

আমেনা বললেন, মায়ের কোলের মতো তো আর কোনো কোল নেই। এক কোল থেকে অন্য কোলে গেলে তো কান্নাকাটি করবেই।

দুপুরের পর শিশুটির নানি কুলছুম বেগম (৫০) এসে পৌঁছলেন। তিনজন আপন মানুষ হারিয়ে তিনি পাগলপ্রায়। বারবার বিলাপ করছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘মুক্তাগোর রাইতে আমার বাসায় থাইকা যাইতে কইছিলাম। থাকলে আর এই ঘটনা ঘটত না।’ এই বলে তিনি মূর্ছা গেলেন।

কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, আশপাশে বিদ্যুতের চোরাই সংযোগ রয়েছে। এসব সংযোগের কারণেই বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে এই চারজনের মৃত্যু ঘটে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় কমার্স কলেজ রোডে কিছু বাসাবাড়ি, দোকান ও ঝিলপার বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ। বাসাবাড়ির দেয়াল কেটে বিদ্যুতের চোরা তার বসিয়ে ওপরে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে আটকানো হয়েছে। অনেক জায়গায় তার এমনভাবে ঝুলে আছে, যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

মিজান স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডের মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এলাকায় টিনশেড বাসায় ভাড়া থাকতেন। পেশায় তিনি শরবত বিক্রেতা ও পরিবহন শ্রমিক ছিলেন। গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে। মুক্তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী সদরে। মুক্তার মা কুলছুম এবং বাবা মাছ ব্যবসায়ী লিটন ওরফে মফিজ মিরপুরের ঝিলপার বস্তিতে থাকেন। তিন বোনের মধ্যে মুক্তা বড় ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার মিজান তাঁর পরিবার নিয়ে ঝিলপার শ্বশুরের বাসায় আসেন, সেখান থেকে বাসায় ফেরার পথে বৃষ্টির মধ্যে তাঁরা দুর্ঘটনার শিকার হন।