স্কুলে যাওয়ার পরে নুসরাত কিছুটা স্বাভাবিক

ছোট বোন মরিয়ম জান্নাতকে নিয়ে যে ঘরে ঘুমাতেন মা-বাবা, সেই ঘরের খাটের ওপরে এখনো তাঁদের কাপড়চোপড় সব ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখা আছে। মা–বাবার কাপড়গুলো আলনায় যেভাবে ভাঁজ করে রাখা ছিল, সেভাবেই রয়েছে। কিন্তু এই ঘরে নুসরাত আর ঢুকতে পারছে না। এক পাশে বাবা, মাঝখানে ছোট বোন, আরেক পাশে মা—একই বেড়ার ভেতরে তিনটি কবর। ওই দিকটাতে যেতে চায় না নুসরাত জাহান। গত ১৫ মে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মা–বাবা ও তার ছোট বোনকে হারায় নুসরাত। নুসরাতের

বাবা আক্তার হোসেন (৪০), মা বীথি খাতুন (৩৩) ও ছোট বোন মরিয়ম জান্নাত (৪) বাড়ি থেকে রাজশাহী যাওয়ার পথে ওই দুর্ঘটনায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই মারা যায় ছোট্ট মরিয়ম। হাসপাতালে নেওয়ার পরে মাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। আর হাসপাতালে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মতো বেঁচে ছিলেন বাবা। কথা বলেছিলেন। খবর পেয়ে চাচার সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিল নুসরাত। বাবা যখন আর কথা বলতে পারছিলেন না, তখন হাতের ইশারায় নুসরাতকে কাছে ডেকেছিলেন। তার মুখটা কাছে নিয়ে চুমু

দিয়েছিলেন। তার কিছুক্ষণ পরই মারা যান বাবা। এই স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছে না নুসরাত। তারপর থেকে একেবারে চুপ হয়ে গেছে।২১ মে সকালে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়নের চণ্ডীপুর গ্রামে নুসরাতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বড় চাচা জাহাঙ্গীর হোসেনের ঘরে চুপচাপ বসে রয়েছে নুসরাত। জাহাঙ্গীর হোসেন বললেন, ‘আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার বড়। নুসরাতের বাবা সবার ছোট। আমার কোনো সন্তান নেই। মেজ ভাইয়ের ছোট একটি মেয়ে আছে। আর নুসরাতরা দুই বোন ছিল। আমাদের পরিবারে এ তিনটি মাত্র সন্তান। তার মধ্যে নুসরাত সবার বড়। নিজের পছন্দে বিয়ে করার কারণে নুসরাতের মা–বাবাকে দুই বছর পরিবারের বাইরে

কাটাতে হয়েছে। নুসরাত হওয়ার সুবাদে তারা বাড়িতে ওঠার সুযোগ পেয়েছিল। তখন নুসরাতের মুখ দেখে সবাই মান–অভিমান ভুলে স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনে ফিরে এসেছিল। আর পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে নুসরাত সবার নয়নের মণি হয়ে ওঠে। এখনো নুসরাত সবার কাছে তা-ই। ওর বাবার ইচ্ছা ছিল, ওকে ডাক্তারি পড়াবে। সবচেয়ে আদরের নুসরাত এখন সবচেয়ে কষ্টে আছে। এটাই পরিবারের সদস্যদের বড় মনঃকষ্টের কারণ হয়েছে। তার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।’যে ঘরে নুসরাতের মা–বাবা ও ছোট বোন ঘুমাতেন, সেই ঘরটা বন্ধ করাই ছিল। দেখতে চাইলে নুসরাতের দাদা মকবুল হোসেন ঘরটা খুললেন, কিন্তু বারবার ডাকার পরও নুসরাত কিছুতেই সেই

ঘরে আসতে চাইছিল না। একপর্যায়ে দাদার কথায় ঘরে ঢুকে দু–একটা কথা বলেই বেরিয়ে গেল। বোঝা গেল, মা–বাবার ঘরে সে দাঁড়াতে পারে না। চাচা জাহাঙ্গীর হোসেন বললেন, মেয়েটিকে নিয়ে তাঁরা খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। ঘটনার তিন দিন পর্যন্ত সে একেবারে চুপ ছিল। চার দিনের দিন সকালে হঠাৎ সে বলে ওঠে, ‘আমি স্কুলে যাব। এভাবে আমি আর থাকতে পারব না।’ পরপর দুই দিন স্কুলে যাওয়ার পরে মেয়েটা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। এখন তার দুই চাচি ও দাদি তাকে আগলে রেখেছেন। একটা ছবি তোলার জন্য অনুরোধ করা হলে নুসরাত বাড়ির উঠানের লিচুগাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তার দাদা বললেন, উঠানের তিনটা লিচুগাছই নুসরাতের বাবার হাতের লাগানো। গাছ তিনটা এখন শুধুই স্মৃতি।