সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষের

একদিকে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ, অন্যদিকে চাল, ডাল, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষগুলো। অনেকে খাবার খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েও খরচের লাগাম টানতে পারছেন না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, অনেকের পক্ষে সংসারের খরচ চালানোই এখন কষ্টকর।

দুই সন্তানের জননী আয়েশা বেগম কাজ করেন মালিবাগ হাজীপাড়ার একটি গার্মেন্টেসে। স্বামী আয়নাল মিয়া চালান রিকশা। দুজনের আয়েই চলে সংসার। ২০২৯ সালে বড় মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার পর খরচ বেড়ে যায়। স্বামীর পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়লেও ওই বছরই ৬ হাজার টাকা বেতনে গার্মেন্টেসে চাকরি নেন আয়েশা বেগম।স্বামী-স্ত্রীর আয়ে ভালোই চলছিল সংসার। একটি ব্যাংকে মাসে এক হাজার টাকা করে সঞ্চয়ও শুরু করেন তারা। কিন্তু গত বছর মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে বদলে যায় জীবনের গতি। নিজের চাকরি থাকলেও ভাটা পড়ে স্বামীর আয়ে। সংসার চালাতে ভাঙতে হয় জমানো টাকা। ধীরে ধীরে যখন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছিল, ঠিক তখনই আবার আঘাত হেনেছে প্রাণঘাতি এই ভাইরাস।

করোনা সংক্রমণ রোধে জনগণের চলাচলের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। এতে আয়েশার স্বামীর আয় অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। সেই সঙ্গে বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তি। ফলে সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন এই দম্পতি।আয়েশা বলন, ‘টিন শেডের দুই রুম ভাড়া নিয়ে থাকি। মাসে ৮ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। আমার আয়ের পুরোটা দিয়েও বাসা ভাড়ার খরচ মেটানো যায় না। ও (স্বামী) আগে মাসে ১৫-১৮ হাজার টাকা আয় করতো। গত বছর করোনা শুরু হওয়ার পর সেই আয় কমে ১০ হাজার টাকার নিচে চলে আসে। এখন লকডাউন দেয়ায় দিনে দুইশ-তিনশ টাকা আয় করাও কষ্টকর হয়ে গেছে। অথচ এখন এক কেজি চাল কিনতে ৫০ টাকার ওপরে লাগে। তেলের কেজি ১৩০ টাকার ওপরে। বাজারে বেশিরভাগ সবজির কেজি ৫০ টাকার ওপরে। এবার বোঝেন, আমাদের সংসার কীভাবে চলছে!’

তিনি বলেন, ‘বাড়তি খরচ কমিয়ে দিয়েছি গত বছর থেকেই। খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। বেশিরভাগ দিন দুপুরে খাই না। তারপরও আমরা খরচের হিসাব মিলাতে পারি না। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কী করবো, সেই চিন্তায় রাতে দুজন ঘুমাতে পারিনা। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কিছু করবো তারও উপায় নেই। কারণ গ্রামের বাড়িতে জমিজমা নেই। কোনো রকমে একটা ঘর আছে।’শুধু আয়েশা নয়, রাজধানীর বাসিন্দাদের একটি বড় অংশের বর্তমান জীবনচিত্র এটি। ছোট ঢাকা শহর কোটি মানুষের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করে দিলেও এর বড় অংশই নিম্ন আয়ের। যাদের একটি অংশ থাকে বস্তিতে।

ঢাকা শহরে কী পরিমাণ মানুষ নিম্ন আয়ের তার কোনো জরিপ নেই। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৪ সালে একটি বস্তি শুমারি করে। ওই শুমারির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট ৩ হাজার ৩৯৪টি বস্তি রয়েছে। এসব বস্তিতে মোট ঘরের সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার। আর বসবাসকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ।তবে বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। তাছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বড় অংশ বস্তির বাইরেও বসবাস করে। এর সঙ্গে ২০২০ সালের শুরুতে দেখা দেয়া করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণেই মধ্যবিত্ত থেকে অনেকে নিম্নবিত্তের তালিকায় নেমে এসেছে।

গত বছরের জুনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক জরিপের তথ্য তুলে ধরে সংগঠনটির সভাপতি আবুল বারকাত বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সরকার ঘোষিত লকডাউনের ৬৬ দিনে মধ্য-মধ্যবিত্তে থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ১ কোটি ২ লাখ নিম্ন-মধ্যবিত্তে নেমেছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তে থাকা ৫ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ দরিদ্র হয়েছেন। আর দরিদ্র থাকা ৩ কোটি ৪০ লাখ থেকে ২ কোটি ৫৫ লাখ হতদরিদ্র হয়েছেন।যাত্রাবাড়ীর একটি টিন শেডে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন রিকশাচালক মো. আব্দুর রহমান। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে মাসে আয় করেন প্রায় ১৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই দুই সন্তান ও পরিবারের খরচ মেটান তিনি।

খরচের তথ্য তুলে ধরে আব্দুর রহমান বলেন, প্রতি মাসে ঘর ভাড়া দিতে হয় ৮ হাজার টাকা। কম খাওয়ার পরও মাসে চাল লাগে ২ হাজার টাকার। সাধারণ বাজার করতে গিয়েই বাকি টাকার প্রায় সবটা চলে যায়। মাছ মাঝে মধ্যে জুটলেও মাংস মাসে একবারের বেশি খাওয়া সম্ভব হয় না।তিনি বলেন, ‘করোনার আগে আয় ভালো হতো। কিন্তু করোনার শুরুর পর আয় কমে গেছে। চলতি বছরে আবার আয় বাড়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন আবার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লকডাউনের কারণে এখন তো সেইভাবে ভাড়া পাওয়া যায় না। তার ওপর চাল, ডাল, তেলের যে দাম ছেলেমেয়ের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দেয়ায় কষ্টকর।আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমি নিজে দুপুরের খাবার ছেড়ে দিয়েছি। মাঝে মধ্যে রাতেও খাই না। তার পরও খরচের লাগাম টানতে পারছি না।’

পোশাক শ্রমিক আয়েশা, রিকশাচালক আব্দুর রহমান ছাড়াও অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং অল্প বেতনের চাকরিজীবীরাও বর্তমান পরিস্থিতিতে হিমশিম খাচ্ছেন। গত ১০ দিনে (৫ থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত) বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত ৫০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই খাবার গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। ১২ জন জানিয়েছেন, তারা মাসে একবারের বেশি মাংস খান না।তাদেরই একজন বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরিরত আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘মাসে ২২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি। বাসা ভাড়া চলে যায় ১২ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে হয়। সবমিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায়, মাসের শেষ কয়েকদিন চলাই কষ্টকর হয়ে যায়। আমি নিজে দুপরে কোনো রকমে খেয়ে থাকি।’তিনি বলেন, ‘ঢাকায় চাকরি করি, তাই গ্রামের সবাই ভাবে, খুব ভালো আছি। আসলে আমাদের সংসার যে কীভাবে চলে তা গ্রামের বাড়িতে যারা থাকেন তাদের বোঝানো যায় না। কোনা রকমে খেয়ে না খেয়ে ঢাকায় টিকে আছি। কোনো সঞ্চয় নেই। গরুর মাংস কালেভদ্রে কপালে জোটে। ব্রয়লার মুরগিও মাসে দুই-তিনবারের বেশি কেনা সম্ভব হয় না।’

এদিকে সম্প্রতি এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের এক জরিপে উঠে এসেছে, করোনা মহামারি শুরুর পর মানুষের আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। বিপরীতে ব্যয় কমেছে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। আর সঞ্চয় কমেছে ৬৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। করোনার কারণে ৮০ দশমিক ৬০ শতাংশ পরিবার খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে।চরের ১০০টি, হাওরের ১০০টি, উপকূলের ১০০টি, বস্তির ৪০০টি, দলিত ১০০টি, আদিবাসী ৩০০টি, প্রতিবন্ধী ১৫০টি, অভিবাসী ১৫০টি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ২০০টি পরিবারের থেকে তথ্য নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা শহরে কত মানুষ নিম্ন আয়ের তা বলা মুশকিল। এটা পরিসংখ্যানের বিষয়। তবে করোনার কারণে অনেকে নিম্ন আয়ের কাতারে চলে এসেছেন। এসব মানুষগুলো এখন নিঃসন্দেহে কষ্ট আছেন।