শিক্ষক হত্যায় জিতু ও তার বাবা গ্রেফতার

সাভারের আশুলিয়ায় শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যায় অভিযুক্ত ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু ও তার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে জিতুকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।এর আগে মঙ্গলবার রাতে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে তার বাবা উজ্জ্বল হোসেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ছেলেকে পালাতে সহায়তা করার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে উজ্জ্বলকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এদিকে আশুলিয়ায় শিক্ষক হত্যা ও নড়াইলে কলেজ অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে নির্যাতনের প্রতিবাদে বুধবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে।নিহত শিক্ষক উৎপল সরকারের প্রতিষ্ঠান হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এদিন আশুলিয়ায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও কালো ব্যাজ ধারণ করেন।এ সময় তারা কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধ দূর করাসহ ছয় দফা দাবি জানিয়েছেন। বুধবার সচিবালয়ে এক সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় কার কতটুকু গাফিলতি তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে সাভারে শিক্ষক হত্যার ঘটনায় তিনি বলেন, এটা নৈতিক অবক্ষয়। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- সাভার ও আশুলিয়া (ঢাকা), কুমারখালী (কুষ্টিয়া) ও শ্রীপুর (গাজীপুর) : র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক (এএসপি) আ ন ম ইমরান খান জানান, শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে হত্যায় মূল অভিযুক্ত স্কুলছাত্র জিতুকে গ্রেফতার করা হয়েছে।তিনি জানান, হত্যার পর জিতু পালিয়ে যায়। সে বেশ কয়েকবার জায়গা পরিবর্তন করে। তবে ঘটনার পর র?্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগরহাওলা গ্রাম থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সেখানে বাল্যবন্ধু বশির শরিফের বাড়িতে আত্মগোপান করেছিল সে। আশুলিয়া থানার এসআই এমদাদুল হক জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানা এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকায় জিতুর বাবা উজ্জ্বলের বাড়ির এক ভাড়াটিয়ার গ্রামের বাড়ি কুমারখালিতে। উজ্জ্বল তার বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করে আশুলিয়া থানায় আনা হয়।এসআই এমদাদুল জানান, বুধবার দুপুরে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উজ্জ্বলকে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়। শুনানি শেষে আদালত তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন এডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আনোয়ারুল কবীর বাবুল। তিনি আদালতে বলেন, পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে আজকাল শিশুদের সঠিক নৈতিক শিক্ষা দিতে না পারায় হত্যাকারী স্কুলছাত্র জিতুর মতো শিশু-কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

জিতুকে আত্মগোপনে সহায়তা করার অভিযোগে এবং তার বর্তমান অবস্থান জানার জন্য তার বাবা উজ্জ্বলের রিমান্ড আবেদন করা হয়। জানা গেছে, শনিবার দুপুরে আশুলিয়ার চিত্রশাইলে হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে শিক্ষক উৎপল সরকারকে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে প্রতিষ্ঠানটির দশম শ্রেণির ছাত্র জিতু।সোমবার ভোরে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় রোববার শিক্ষকের ভাই অসীম কুমার সরকার জিতুসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের সড়কে মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি পালন করেন তারা। মানববন্ধন থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছয়টি দাবির কথা জানিয়েছেন।

সেগুলো হলো-মামলার প্রধান আসামি স্কুলছাত্রকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার, অজ্ঞাতনামা আসামিদের গ্রেফতার, প্রধান আসামি স্কুলছাত্রের পরিবারের পলাতক সদস্যদের আইনের আওতায় আনা, নিহত শিক্ষকের পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্থানীয় ও বাইরের শিক্ষার্থী হিসাবে ভেদাভেদ দূর করতে আইন প্রণয়ন এবং কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধ দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা জানায়, শিক্ষক উৎপল সরকারকে পেটানোর পর ওই দিন বিকালেও জিতু এলাকায় বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিয়েছিল। হাসপাতালে শিক্ষকের অবস্থার অবনতি হলে পরদিন জিতু ও তার পরিবার পালিয়ে যায়। হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় ঘাতকের এমন শাস্তি কামনা করছি, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস না পায়।

বুধবার দুপুরে হাজী ইউনুছ আলী কলেজ পরিদর্শন করেন ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের জানান, শিক্ষক হত্যার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত চলছে। মামলায় অভিযুক্তের বয়স কম দেখানো হয়েছে এমন এক অভিযোগের উত্তরে তিনি বলেন, মামলায় কী দেখানো হলো, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, প্রয়োজনে ডাক্তারি পরীক্ষা করে বয়স নির্ধারণ করা হবে।এ সময় ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির, আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এসএম কামরুজ্জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। নড়াইলে অধ্যক্ষকে লাঞ্ছনায় অন্যতম আসামি গ্রেফতার : নড়াইলে কলেজ অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় অন্যতম আসামি রহমাতুল্লাহ রনিকে (২২) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে খুলনার ছোট বয়রা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার রনি সদর উপজেলার রুখালী গ্রামের মৃত জাবেরের ছেলে। একই ঘটনায় এর আগে গ্রেফতার তিনজনের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছে পুলিশ। নড়াইল সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাহামুদুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।তিনি বলেন, গ্রেফতার আসামিদের সদর আমলী আদালতে হাজির করে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করলে আদালত আগামী ৩ জুলাই শুনানির দিন ধার্য করেন।

১৭ জুন নড়াইল সদরের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক ছাত্রের আপত্তিকর পোস্ট কেন্দ্র করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করা হয়।পূর্বধলা (নেত্রকোনা) : শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের হত্যাকারীকে দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক নির্যাতনের প্রতিবাদে পূর্বধলায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ হয়েছে। বুধবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ গেটের সামনের সড়কে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি পূর্বধলা উপজেলা শাখার উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালিত হয়। নাজিরপুর (পিরোজপুর) : শিক্ষক হত্যা ও লাঞ্ছিতের প্রতিবাদে নাজিরপুরে শিক্ষকরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন। সকালে উপজেলা পরিষদের সামনে বিভিন্ন স্কুল, কলেজের শিক্ষকরা এতে অংশ নেন। গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) : বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা শাখা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশে শিক্ষক হত্যা ও লাঞ্ছিতের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়। শহরের পুরাতন সোনালী ব্যাংক কৃষ্ণচূড়া চত্বরে এ কর্মসূচি পালিত হয়।

ঢাবিতে পাঁচ শিক্ষার্থীর আমরণ অনশন : শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে আমরণ অনশনে বসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থী। বুধবার বেলা সাড়ে ৩টায় ক্যাম্পাসে রাজু ভাস্কর্যের সামনে অনশনে বসেন তারা।পরে আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী সংহতি জানিয়ে তাদের পাশে কিছুক্ষণ অবস্থান করেন। অনশনে বসা শিক্ষার্থীরা হলেন-তরিকুল ইসলাম, চৌধুরী শামীম আফফান, মোস্তফা কামাল রনি, মেহেদী হাসান ও নাঈম পারভেজ।পাঁচজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্যসেন হলের শিক্ষার্থী। অনশনরত তরিকুল বলেন, যে প্রজন্ম শিক্ষককে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, সেই প্রজন্মের লাগাম এখনই টেনে ধরতে হবে। এছাড়া শিক্ষক নির্যাতন ও শিক্ষক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ছাত্র ফেডারেশন। বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতি : শিক্ষক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। তারা অবিলম্বে শিক্ষক নির্যাতন বন্ধ ও দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানায় সংগঠনটি।রাবিতে শিক্ষককে লাঞ্ছিত করায় শিক্ষার্থী বহিষ্কার : একাধিকবার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে লাঞ্ছিত করা ও হত্যার হুমকির অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) প্রশাসন।বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীর নাম আশিক উল্লাহ। তিনি আইন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। শহীদ জিয়াউর রহমান হলের ছাত্র।