মোবাইলে বাধ্যতামূলক বিজয় কি-বোর্ড, যা জানা গেল

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং আমদানিকরা সব ধরনের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড প্যাকেজ কিট (এপিকে) ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিজয় কি-বোর্ড অন্যান্য সাধারণ প্রি-ইনস্টলড অ্যাপগুলোর মতো ইনস্টল করা থাকলে এবং সেটা ফোনে লক করা না থাকলে কেউ চাইলে সেটা রিমুভ বা আনইনস্টলও করতে পারবেন। ব্যবহারকারী যে অ্যাপে অভ্যস্ত তিনি সেটাই ব্যবহার করতে পারবেন। এ ব্যাপারে সাধারণ ব্যবহারকারীর জন্য সেটি ব্যবহারে কোনো বাধ্যবাধকতার বিষয় থাকে না।

এ বিষয়ে বিটিআরসির তরঙ্গ বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান জুয়েল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এখানে যেটা হয়েছে আমাদের সরকার কর্তৃক প্রমিতকৃত যে কি-বোর্ড লে-আউট সেটা শুধু ইনস্টল করা থাকবে। এটা বাধ্যবাধকতার কিছু নেই। আপনি আপনার মতো যেটাই ইচ্ছা, সেটা ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু যেটা প্রমিত সেটা থাকবে। এটা নির্দেশনা শুধু আমরা বাস্তবায়ন করেছি। এটা শুধু ওখানে থাকবে। কারও যদি পছন্দ না হয় সে রিমুভ করে ফেলবে। এটা তার ব্যাপার। আমরা যে এপিকে দিয়ে দেব তারা সেই এপিকে ফাইলটা ফোনের ভেতর ইনস্টল করে দেবে এটুকুই। এর চেয়ে বেশি কিছু না।’

এটি সাধারণ ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করবে কি না সে বিষয়ে জানতে চাইলে তরঙ্গ বিভাগের মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘এটা থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা হবে না। এটা জাস্ট নরমাল একটা কি-বোর্ড। এ কি-বোর্ড যারা ব্যবহার করতে চায় তারা ব্যবহার করবে। যারা অন্য কি-বোর্ডে অভ্যস্ত তারা অন্য কি-বোর্ড ব্যবহার করবে। তার তো সেই সুযোগ আছেই। ডেটা কালেকশন করার কোনো কি-বোর্ড না এটা।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অন্যান্য ফোন সেটেও পরীক্ষা করে দেখেছি এটার কারণে সেটের বা পারফরমেন্সের কোনো সমস্যা হয় না। আপনি যখন একটা সেট কেনেন তখন অনেকগুলো অ্যাপস তো লোড করাই থাকে। এটাও সেরকম একটা অ্যাপস। এটা অফলাইন থাকবে, শুধু নরমালি প্রি-ইনস্টল করা থাকবে। কোনো ডেটাবেসের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে না।’

সরকারের নির্দেশে উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকদের মাধ্যমে বিজয় কি-বোর্ড ইনস্টলের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর এ কে এম আশিকুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘গুগল-প্লে স্টোর ভেরিফাই করার পর অ্যান্ড্রয়েড প্যাকেজ কিট বা এপিকে অনুমোদন করে। ভেরিফিকেশনটাও তারা করে। সোর্স কোডের মধ্যে এরকম কিছু আছে কি না যেটা প্রাইভেসি লঙ্ঘন করবে, সে বিষয়ে ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর গ্রিন সিগন্যাল পাঠায়। এরপরা সেটা গুগল-প্লেতে রাখা হয়। তা না হলে কিন্তু রাখা হয় না। এ কারণে গুগল-প্লের জিনিসপত্র আমরা মোটামুটি রিস্ক ছাড়া ইনস্টল করে ফেলি। আর অন্যান্য অ্যাপ ইনস্টল করার আগে হয়তো ১০-১২ বার চিন্তা করতে হয়।’

ডক্টর আশিকুর রহমান বলেন, ‘এটা যদি গুগল-প্লে থেকে ইনস্টলের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে আমার মনে হয় সিকিউরিটির বিষয়টি এনসিউরড হবে। তাই গুগল-প্লে স্টোর বা এ ধরনের থার্ড পার্টি কারও মাধ্যমে কাজটা করা গেলে বিষয়টা আরও সিকিউরড হতো, বিশ্বাসযোগ্য হতো।’

বিজয় কি-বোর্ডের মাধ্যমে গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করা যাবে কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক আশিকুর রহমান বলেন, ‘বিজয় একটি অফলাইন কি-বোর্ড, অনলাইন না। অফলাইন যেহেতু এটি আর কারও সঙ্গে কমিউনিকেট করে না।’

বিটিআরসির নির্দেশনার বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাধ্যবাধকতা যেটুকু দেওয়া হয়েছে সেটা মোবাইল ফোন ব্যাবহারকারীদের দেওয়া হয়নি। মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী এবং যারা আমদানিকারক তাদেরকে দেওয়া হয়েছে। যে ব্যবহারকারী, তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু মোবাইল ফোন যখন ব্যবহারকারীর হাতে যাবে তখন বাংলা লেখার জন্যে একটা সফটওয়্যারসহ যাবে, দ্যাটস ইট।’

বিজয় কি-বোর্ডই কেনো ব্যবহার করতে হবে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘মোবাইলে বিজয় ব্যবহার করা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। বিষয়টি একটু স্পষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে। সরকারের নির্দেশনা আছে, মোবাইল ব্যবহারকারীরা যাতে বাংলা ব্যবহার করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ফিচার ফোনের জন্য আইসিটি ডিভিসন বিডিএস ১৮৩৪:২০১১ নামের স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে তার ভিত্তিতে সফটওয়্যার তৈরি করে মোবাইলে দেওয়া বাধ্যতামূলক করে।’

‘পরবর্তীতে স্মার্টফোনের জন্য কম্পিউটারের কি-বোর্ড ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। আইসিটি ডিভিশনের কম্পিউটার কাউন্সিল কম্পিউটারের জন্য বিজয়ের দুটি বোতাম পরিবর্তন করে বিডিএস ১৭৩৮:২০০৪ স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে। ২০১৭ সালে কম্পিউটার কাউন্সিল ১৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে মানগুলো রিভিউ করে। বিডিএস ১৭৩৮ এর রিভিউ করে বিজয় কি-বোর্ড প্রমিত মান হিসেবে সিদ্ধান্ত নেয় ও বিডিএস ১৭৩৮:২০১৮ নামে এটি প্রমিত করা হয়।’

‘বিটিআরসি আইসিটি বিভাগের সেই মানটিই মোবাইলে বিনামূল্যে বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। বিটিআরসি আইসিটি বিভাগের মান মেনে চলতে বাধ্য। সেটাই তারা করেছে। আমদানিকারক বা উৎপাদক তাদের কাউকে এজন্য এক টাকাও ব্যয় করতে হচ্ছে না। ব্যবহারকারী ইচ্ছা করলে অন্য সফটওয়্যারও ব্যবহার করতে পারবে। বিজয় কি-বোর্ড মোবাইলে লক করা নয়।’

এ ছাড়া অ্যাপটিতে বিজ্ঞাপন এবং রেস্ট্রিকশনের বিষয়ে মন্ত্রী দ্য ডেইলি স্টার-কে বলেন, ‘অ্যাপটিতে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন, কোনো ধরনের রেস্ট্রিকশন, কোনো কিছু থাকবে না। ব্যবহারকারী যদি ফোনটা হাতে নিয়েই মনে করে যে আনইনস্টল করে দেবে, দিতে পারবে। কিন্তু এটি বিটিআরসিরর জন্যে বাধ্যতামূলক যে, ফোন সেট জনগণের হাতে পৌঁছানোর সময় বাংলা লেখার একটা সফটওয়্যার যেন তাতে দেওয়া থাকে। বিটিআরসি সেই কাজটাই করেছে, এর মধ্যে কোনো রকমের ঝামেলা করার কিছু নেই। কোনো ধরনের কিছু নেই।’

এপিকেটি ওপেন সোর্স সফটওয়্যার কিনা সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলা কোনো ওপেন সোর্স সফটওয়্যার নেই। কোনো থার্ড পার্টির মাধ্যমে এটি পাওয়া যাবে না, বিটিআরসি এটা দেবে।’এর আগে গত শুক্রবার বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) দেশের সব মোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ মোবাইল ফোন আমদানিকারক সমিতির সভাপতিকে এ বিষয়ে নির্দেশনা পাঠায়। নির্দেশনায় বলা হয়, আমদানি করা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সব ধরনের অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড প্যাকেজ কিট (এপিকে) ব্যবহার করতে হবে। বিজয় এপিকে ফাইল ছাড়া কোনো ধরনের স্মার্টফোন দেশে বাজারজাত করতে দেওয়া হবে না।