‘মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করি’

নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে। সে সময় কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপার (এসপি)। তাঁদের সঙ্গে ছিল ২০০ থেকে ২৫০ পুলিশ।ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘যখন মাইকে কয়েকবার জুতার মালা পরানোর ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন আমার মনে হচ্ছিল, আমি ভবনের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করি। কিন্তু তিন সন্তান, স্ত্রী ও মায়ের কথা ভেবে সেটা পারিনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিনা অপরাধে শত শত শিক্ষার্থীর সামনে জুতার মালা গলায় দিয়ে ছবি-ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হলো। এ লাঞ্ছনার পরে আমি আর কাউকে মুখ দেখাতে চাইনি।’নড়াইলে এ ঘটনা ঘটে ১৮ জুন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, এক শিক্ষার্থী ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করেছে, এই দাবি করে বিপুলসংখ্যক মানুষ কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে। পরে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করা হয়। এর ভিডিও চিত্র অনলাইনে ছড়িয়ে পড়েছে।‘আমি এবং পুলিশ সুপার কলেজের মূল ফটকের সামনে থেকে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের অগোচরে কক্ষ থেকে অধ্যক্ষ ও শিক্ষার্থীকে বের করার সময়ে তাঁদের গলায় জুতার মালা পরানো হয়। এটা আমাদের অগোচরেই ঘটেছে।’মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, নড়াইলের জেলা প্রশাসকএদিকে শিক্ষককে অপদস্থ করার ওই ঘটনায় দেশজুড়ে সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে ৯ দিন পর গত সোমবার একটি মামলা হয়েছে। মামলায় ওই দিন রাতে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগে শিক্ষার্থীটির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। তাকেও

আইনি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।ঘটনার পর থেকে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস বাড়িছাড়া। তাঁর পরিবার আতঙ্কে রয়েছে। তবে তাঁর বাড়ির সামনে পুলিশ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে।সাভারের আশুলিয়ায় কলেজের ভেতর শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তারসহ ৬ দফা দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। গতকাল দুপুরে কলেজের সামনেসাভারের আশুলিয়ায় কলেজের ভেতর শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তারসহ ৬ দফা দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। গতকাল দুপুরে কলেজের সামনেছবি: শামসুজ্জামানমির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজটি নড়াইল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। এটি এমপিওভুক্ত (বেতন বাবদ সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত)। পড়াশোনা হয় স্নাতক (পাস) পর্যন্ত।অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস, কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ১৭ জুন মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী নিজের ফেসবুক পেজে ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপির বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর

শর্মাকে প্রণাম জানিয়ে ছবিসহ একটি পোস্ট দেয়। পরদিন সকাল ১০টার দিকে ওই শিক্ষার্থীকে কলেজের ফটকের সামনে পেয়ে ১০–১২ জন ছাত্র অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। তখন কলেজের হিসাবরক্ষক আলাউদ্দীন মোল্লা তাদের শিক্ষকদের কক্ষে নিয়ে যান। ছাত্ররা তখন ওই শিক্ষার্থীর ফেসবুক পোস্টটি অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসসহ শিক্ষকদের দেখায়।ফেসবুক পোস্টটি দেখার পর স্বপন কুমার বিশ্বাস কলেজের শিক্ষক, ওই শিক্ষার্থীর বাবা ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের কয়েকজন সদস্যকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, আলোচনায় নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীকে তাদের কাছে সোপর্দ করা হয়। সাদাপোশাকে যাওয়া তিন পুলিশ সদস্য ওই শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাস থেকে নিয়ে যেতে চাইলে উত্তেজিত ছাত্র ও বহিরাগত কয়েকজন বাধা দেয়। তখন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বিষয়টি জানানো হয়।‘আমরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পারতাম। কিন্তু তাতে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতে পারত।’ তিনি বলেন, ‘যেটা ঘটেছে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।’প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, ধীরে ধীরে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। দুপুরের পর প্রথমে নড়াইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অ্যাডিশনাল এসপি) কিছু পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। তবে তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি। এর মধ্যেই কলেজের তিনজন হিন্দু শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে আরও পুলিশ নিয়ে সেখানে যান নড়াইলের পুলিশ সুপার।একপর্যায়ে জেলা প্রশাসকও কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হন। বিকেল চারটার দিকে হ্যান্ডমাইকে জুতার মালা পরানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সময় শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস এবং ওই শিক্ষার্থী কলেজের ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁদের কক্ষটি থেকে বের করা হয়। নিচতলার কলাপসিবল গেটের সামনে আনার পর গলায় জুতার মালা

পরিয়ে দেওয়া হয়।প্রশাসন ও পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষককে অপদস্থ করার ঘটনা কীভাবে ঘটল, জানতে চাইলে নড়াইলের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এবং পুলিশ সুপার কলেজের মূল ফটকের সামনে থেকে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিলাম। আমাদের অগোচরে কক্ষ থেকে অধ্যক্ষ ও শিক্ষার্থীকে বের করার সময়ে তাঁদের গলায় জুতার মালা পরানো হয়। এটা আমাদের অগোচরেই ঘটেছে।’পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পারতাম। কিন্তু তাতে অবস্থা আরও ভয়াবহ হতে পারত।’ তিনি বলেন, ‘যেটা ঘটেছে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।’এদিকে শিক্ষককে অপদস্থের ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়লে তা দেখে মানুষ ধিক্কার জানাতে শুরু করে। বিশিষ্ট নাগরিকদের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ জানায় ও কর্মসূচি পালন করে। এরপর গত সোমবার শিক্ষককে অপদস্থের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে দায়ের করা পুলিশের মামলায় অজ্ঞাতনামা ১৭০ থেকে ১৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনকে সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন নড়াইল পৌর যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মনিরুল ইসলাম ওরফে রুবেল, ইজিবাইকের চালক সৈয়দ রিপন আলী ও ব্যবসায়ী শাওন খান। তিনজনেরই বাড়ি মির্জাপুর গ্রামে।এদিকে ঘটনা তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জুবায়ের হোসেন চৌধুরী।ঘটনার পর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর পরিবার আতঙ্কে রয়েছে। শিক্ষার্থীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় চারজন পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। বাড়িতে কোনো পুরুষ সদস্য নেই।শিক্ষার্থীর মা প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের নূপুর শর্মাকে প্রণাম জানানোর অভিযোগে তাঁর ছেলেকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। ভারতে তাঁদের পরিবারের কেউ কোনো দিনও যায়নি। পরিবারের কারও পাসপোর্টও নেই। তিনি আরও বলেন, সেটা তার নিজের লেখাও না। ফেসবুকে পেয়ে তাঁর ছেলে সেটি পোস্ট করেছে। ঘটনার পর থেকে তাঁদের আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে।শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের বাড়ি নড়াইল শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে। গতকাল দুপুরে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশে মন্দিরের সামনে পুলিশের পাহারা বসানো হয়েছে। স্বপন কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে, সেটি ভীষণ লজ্জার। আমি এখন শ্রেণিকক্ষে ফিরব কীভাবে?’হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত চিকিৎসার জন্য ভারতে গেছেন। মতামত জানতে চাইলে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষক স্বপন কুমারের নিগৃহীত হওয়া বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ২০১১ সাল থেকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে সংখ্যালঘু শিক্ষকদের ওপর একের পর এক নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় কখনো কখনো শাসক দলের কিছু লোকও জড়িত থাকছে। এরা শাসক দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মানুষ। যারা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে।রানা দাশ গুপ্ত আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতেই সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন ঘটছে। এ নিয়ে আমরা একাধিকবার প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি। তারা আশ্বাস দিয়েছে, এসবের পুনরাবৃত্তি হবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব প্রতিশ্রুতি পালিত হয়নি।’