ভ্যান চালিয়ে ভাইদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন সলেমান

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাত্র ১১ বছর বয়সে সলেমান কাজ শুরু করেছিলেন একটি ফার্নিচারের দোকানে। মিস্ত্রির সহকারী হিসেবে। সারাদিন সেই ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে হাতে ফোসকা পড়ে যেত তার। এরপর সলেমানের বাবা তাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে নিজের সাথে মাঠে কাজ করার জন্য। সেই থেকেই শুরু সলেমানের জীবন সংগ্রাম। বড় বোনের পড়াশোনা থেকে বিয়ে দেয়া এবং ছোট চার ভাইকে দেশের সেরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে গিয়ে প্রায় ১৫ বছর ভ্যান চালিয়েছেন সলেমান। করেছেন কৃষিকাজ, এমনকি দিনমজুরের কাজও।

ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ধরনী ধরদী গ্রামের আব্দুল করিম মোল্যার বড় ছেলে সলেমান মোল্যা। তবে এখন আর ভ্যান চালানো কিংবা দিনমজুরি করা লাগে না সলেমানের। ভাইয়েরা মিলে জমি কিনেছে, সেই জমিতেই কৃষিকাজ করেন তিনি। সলেমান এখন গ্রামের সেরা কৃষক। তার ভাইয়েরাও পিতার মতো বড় ভাইয়ের শ্রমের মূল্য দিয়েছেন, পড়াশোনা করে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।সলেমানের এক ভাই আবুল খায়ের। তিনি সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করে ডাক বিভাগের সাব রেকর্ড সুপারভাইজার পদে চাকরি করেন গোপালগঞ্জে।

আরেক ভাই নাসিরুদ্দিন ফুরকান। সরকারি বাঙলা কলেজের বাংলা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান) পাশ করে এখন সাংবাদিকতা করছেন দেশের প্রথম শ্রেণির একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায়।এরপরের ভাই কিবরিয়া মোল্যা। ঢাকা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক (সম্মান) শেষ করেছেন প্রথম শ্রেণিতে। তিনি একজন সফল কনটেন্ট ক্রিয়েটর। কাজ করেন কিডস এডুকেশন নিয়ে।সবার ছোট ভাই জুবায়ের রহমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। থাকেন হাজী মুহম্মদ মহসিন হলে। ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে সম্প্রতি ছোট ভাই জুবায়েরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে এসেছেন সলেমান। জুবায়ের তার পিতৃতুল্য বড় ভাইকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ। মহসিন হলের অতিথি কক্ষের সোফায় বসিয়ে বড় ভাই সলেমানের একটি ছবি তুলেছেন জুবায়ের। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন আরেক ভাই ফুরকান। নয়া শতাব্দীর পাঠকদের জন্য সলেমানের ভাইয়ের সেই স্ট্যাটাসটি হুবুহু তুলে ধরা হলো-সলেমানের ভাই নাসিরউদ্দিন ফুরকান লিখেছেন,

ছবিটি দেখে আমার চোখে টল টল করে পানি এলো৷ চোখ ভিজে গড়িয়ে পড়েছে৷ আমাদের ৪ ভাই ও ১ বোনের দাদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে এসেছে। জুবায়ের তার হলে নিয়ে ছবিটি পোস্ট করেছে ৷ দাদা নিজে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলো আব্বার সুদের টাকার ঋণ আর আমাদের এতোগুলা ভাইবোনের মুখে ভাত তুলে দিতে।

আমার মনে আছে আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। দাদা কাদিরদী ফার্নিচারের দোকানে মিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেছিলো মাত্র ১১ বছর বয়সে। তার হাতে ফোসকা পড়ে যেতো। স্কুলে যাওয়ার সময় দেখতাম কাজ করতে। এরপর আব্বা সেখান থেকে নিয়ে আসে তার সাথে মাঠে কাজ করার জন্য। নিজের পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি দাদা৷ আমাদের দাদারও বড় যে বোন আছে সেও তাকে দাদা বলে। কারণ বোনের বিয়ে থেকে শুরু করে সব দায়িত্ব এখন পর্যন্ত পালন করে আসছে দাদা৷আমাদের দেশের সেরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চেনানো মানুষ তিনি। তাকে যতটুকু চিনি আমাদের সবার চেয়ে সে ভালো ছিলো পড়াশোনায়। তার মেধা ছিলো। নিজে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলেও আমাদের তার কাজ করতে দিতো না। সে চাইতো আমাদের জীবনে এতো পরিশ্রম যেন করতে না হয়৷ এখন আমাদের কোনো অভাব নেই৷ মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছি। সবাই দাদার সাথে আছি। আব্বার সমান অবদান দাদার। বেশি বললেও ভুল হবে না৷

অনেক বড় বড় মানুষ, অনেক ধনী মানুষ যা পারেনি দাদা তা পেরেছে। একজন হৃদয়বান মানুষের পরিচয় দিলাম। একজন খাঁটি, নির্লোভ ও সৎ মানুষের পরিচয় দিলাম। যিনি আমাদের ১৭ জনের পরিবারকে কত সুন্দর করে নির্মান করে যাচ্ছেন। একসাথেই বাঁচতে চাই বাকি জীবন। তার জন্য কিছু করতে পারিনি। সে এখনও তার ৩ সন্তানের সাথে আমাদেরও সন্তানের মতো লালন করে চলেছেন। আমাদের বউ বাচ্চারাও তার আশ্রয়ে লালিত হচ্ছে। যারা তাকে চেনেন, তারা শতভাগ আইডল মানেন। দাদাকে নিয়ে পোস্ট দিতে পেরে মনে হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটিকে নিয়ে পোস্ট দিলাম। এমন দাদা যারা পেলো তারা দুনিয়ায় এক টুকরো স্বর্গ পেয়েছে। তার ঋণ শোধ করার দুঃসাধ্য কারো নেই। দাদাকে স্যালুট। সবাই দাদার জন্য দোয়া করবেন।