বৃদ্ধ বাবা‌কে কাঁধে নেওয়ার ছ‌বি ভাইরাল, প্রশংসায় ভাস‌ছেন ছে‌লে

পবিত্র ঈদুল ফিতরের জামাতে অংশ নিতে গিয়ে ঝড়-বৃষ্টিতে ঈদগাহে আটকে পড়া অসুস্থ বৃদ্ধ বাবাকে কাঁধে করে বাড়িতে নিয়ে আসার একটি ছবি গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। গত মঙ্গলবার (৩ মে) ঈদুল ফিতরের দিন কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ার সরকার বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে।

শুক্রবার (৬ মে) সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাকুন্দিয়া উপজেলার সুখিয়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ার আব্দুল হেকিম (৭৮) দীর্ঘদিন ধরে হাঁপানি ও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। অসুখ আর বয়সের ভারে স্বাভাবিক চলাফেরা করতে অক্ষম তিনি। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে অন্যান্য মুসল্লিদের সঙ্গে এবারের ঈদুল ফিতরের জামাত আদায়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেন আব্দুল হেকিম। তাই ঈদুল ফিতরের দিন সকালে তার একমাত্র ছেলে সন্তান দুলাল মিয়ার (২৭) সঙ্গে কথা বলেন। তাদের মধ্যে কথা হয় যে ঈদগাহ থেকে ফিরে দুইজন একসঙ্গে খাবার খাবেন।

আব্দুল হেকিম অসুস্থ থাকায় একটু আগেই ঈদগাহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। ছেলে দুলাল মিয়া একটু পরে যাবেন বলে বাবাকে জানান। এর কিছু সময় পরই ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে দুলাল মিয়া আর ঈদগাহে যেতে পারেননি। তিনি মসজিদে ঈদের জামাত শেষ করে বাড়িতে ফিরে দেখেন বাবা বাড়িতে নেই। মাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান- এখনো বাড়ি ফেরেননি। পরে ছেলে দুলাল মিয়া ঈদগাহে গিয়ে দেখেন তার বাবা বৃষ্টির মধ্যে একা একাই বসে আছেন। তখন দুলাল বাবাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে চান । বাবা বলেন আমার হাঁপানি বেড়ে গেছে হাঁটতে পারছি না। তখন দুলাল বৃষ্টির মধ্যেই তার বাবাকে কাঁধে তুলে বাড়ির দিকে রওনা হন। পথে লিমন হাওলাদার নামে এক যুবক সেই ছবি তুলে ফেসবুকে দিলে তা ভাইরাল হয়ে যায়। পুরো উপজেলার মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে পিতৃভক্তির এই ঘটনা।

এ বিষয়ে দুলাল মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ঢাকায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করি। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। ঈদের দিন আমি একটু পরে ঈদগাহে রওনা হওয়ায় বৃষ্টির কারণে ঈদগাহে যেতে পারিনি। তাই বাড়ির মসজিদেই নামাজ পড়েছি। বৃষ্টির মধ্যেই বাড়িতে গিয়ে দেখি বাবা বাড়িতে নেই। পরে বুঝতে পারলাম বাবা বৃষ্টির মধ্যে আটকা পড়েছেন। পরে ছাতা নিয়ে ঈদগাহে গিয়ে দেখি বাবা একা একা বসে আছেন। আমাকে দেখে প্রাণ ফিরে পেলেন। পরে বাবাকে বলি চলেন বাড়িতে যাই। বাবা বলেন, আমার হাঁপানিটা বেড়ে গেছে, হাঁটতে পারছি না। তখন আমি বাবাকে কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হই।তিনি বলেন, আমি মোটেও ভাইরাল হওয়ার জন্য এমন কাজ করিনি, কখনো কল্পনাও করিনি। আমি শুধু সন্তান হিসেবে আমার জন্মদাতা অসুস্থ বাবার সেবায় ছোট্ট দায়িত্বটি পালন করেছি।

বাবা আব্দুল হেকিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৃষ্টির মধ্যেই নামাজ শেষ হয়। নামাজ শেষে সবাই বাড়ি ফিরে গেলেও আমি হাঁটতে পারছিলাম না। তাই মাঠে বসে ছিলাম। তখন খুব ভয় করছিল যদি বজ্রপাত হয়, তাহলে হয়তো মারা যাব। একটু পরেই দেখি দুলাল ছাতা নিয়ে হাজির। আমি না হাঁটতে পারায় আমার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও দুলাল আমাকে কাঁধে করে বাড়ি নিয়ে আসে। আমি দুলালের জন্য দোয়া করি। দুলালের মতো সন্তান যেন প্রতিটি ঘরে জন্ম নেয়। ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করা যুবক লিমন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমিও বৃষ্টির জন্য মসজিদে ঈদের নামাজ পড়েছি। পরে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি বৃষ্টির মধ্যে দুলাল তার বাবাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বাড়ি ফিরছে। এমন দৃশ্য দেখে আমি ছবিটি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করি।

সুখিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য আকরামুন্নেছা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্তমান সময়ে অনেক ছেলে-মেয়ে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠায়। কিন্তু দরিদ্র দুলাল মিয়া তার বাবাকে বৃষ্টির মধ্যে কাঁধে তুলে ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরেছে। পিতৃভক্তির এমন ঘটনা এলাকার অন্যান্য সন্তানদের সামনে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এমন কর্তব্যবোধের কারণে তিনি এখন প্রশংসার জোয়ারে ভাসছেন। এমন দায়িত্ববোধ গর্ব ও অহংকারের। সব সন্তানদেরই বয়োবৃদ্ধ-অসুস্থ ও স্বাভাবিক চলাফেরা করতে অক্ষম বাবা-মায়ের প্রতি এমন যত্নবান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তাইলেই আমাদের সমাজ সুন্দর হবে।