পান বিক্রেতা থেকে কোটিপতি ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী নেতা হাজী সেলিম!

বাবা ছিলেন পানের দোকানদার, তিনি নিজেও পানের ব্যবসা দিয়েই শুরু করেছিলেন উপার্জন। সেই মানুষ এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক, জায়গা-জমি থেকে শুরু করে পেট্রোল পাম্প, কোল্ড স্টোরেজ, ভবন, মার্কে’টের যেন শেষ নেই। এই উত্থানের র’হস্যটা কোথায়?বাবা ছিলেন পানের দোকানদার, তিনি নিজেও পানের ব্যবসা দিয়েই শুরু করেছিলেন উপার্জন। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা আর ক্ষমতার অ’পব্যবহারেকে কাজে লাগিয়ে সময়ের পটপরিবর্তনে তিনি হয়ে উঠেছেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, জায়গা করে নিয়েছেন সং’সদে, পুরান ঢাকার ত্রাস হিসেবে তাকে এবং তার পরিবারের সদস্যদের চেনে সবাই। এমনই তাদের প্রভাব যে, শত অ’ত্যাচার নি’র্যাতন সয়েও প্রা’ণেও ভ’য়ে অন্যায়ের বি’রুদ্ধে মুখ খুলতে চায় না কেউ। তিনি হাজী সেলিম, ঢাকা-৭ আসনের সাংসদ এবং আওয়ামী লীগ নেতা। নৌবাহিনীর এক লেফট্যানেন্টকে মা’রধরের ঘটনায় ছেলে ইরফান সেলিমের গ্রে’প্তারের ঘটনায় যিনি আবার ‘টক অব দ্য টাউন’ এ পরিণত হয়েছেন আরও একবার।

বণিক বার্তায় হাজী সেলিমের রাজনৈতিক উত্থান নিয়ে অনুসন্ধানী একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দিন দুয়েক আগে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও এখন হাজী সেলিম একটা হটকেকের নাম। কীভাবে তিনি আজকের এই অবস্থানে এলেন, পুরান ঢাকার অঘোষিত ত্রাসে পরিণত হলেন, কিংবা হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তির মালিক হলেন- সেসব নিয়ে প্রচুর খবর প্রকাশিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে সবাই হাজী সেলিমকে চিনলেও, তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল বিএনপির হাত ধরে। দলটির মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষি’প্ত হয়ে তিনি আওয়ামী লীগে ভিড়েছিলেন। শূন্য থেকে শিখরে ওঠার ‘অন্যরকম’ একটা কেস স্টাডি হিসেবে হাজী সেলিমের গল্পটা অনেকের জন্যেই ‘অনুপ্রেরণা’ হয়ে থাকতে পারে।সোয়ারীঘাটে পানের ব্যবসা করতেন হাজী সেলিমের বাবা চান মিয়া। বাবার হাত ধরেই ব্যবসায় হাতেখড়ি হয় সেলিমের। সে’নাশাসনের সময়টাতে কোমল পানীয় সেভেন আপের এজেন্সি খুলে বসেন তিনি, সেখান থেকে নকল সেভেন আপ বিক্রির অ’ভিযোগ ছিল তাদের বি’রুদ্ধে। এই অ’ভিযোগে হাজী সেলিম, তার বাবা চান মিয়া এবং বড় ভাই কায়েস মিয়া পুলিশের হাতে গ্রে’প্তারও হয়েছিলেন, জে’ল খাটতে হয়েছিল তাদের।

জে’ল থেকে বেরিয়ে তিনি শুরু করলেন সিমেন্টের ব্যবসা, কিন্ত এখানেও দুই নম্বুরী করার অ’ভিযোগ উঠলো। সিমেন্টের সঙ্গে বালি ও মাটি মিশিয়ে বাজারজাত করতেন সেলিম- এমন কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল তৎকালীন সময়ের পত্র-পত্রিকায়। সিমেন্টের পাশাপাশি সেলিম শুরু করেছিলেন ফলের ব্যবসাও, এসময় বাদামতলী, ওয়াইজঘাট ও সদরঘাট এলাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেন তিনি।ব্যবসা করতে করতেই হাজী সেলিম (তখনও তিনি হজ করেননি) বুঝতে পেরেছিলেন, ক্ষমতার ধারেকাছে না থাকলে ও’পরে ওঠা সম্ভব নয়। নব্বইয়ের দশক, এরশাদের স্বৈ’রাচার স’রকারের পতন হয়েছে কিছুদিন আগে। বিএনপি তখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। বিএনপি নেতা মীর শওকতের হাত ধরে রাজনীতিতে উত্থান হয় হাজী সেলিমের। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৬৫ ও ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে গরুর গাড়ি মার্কা নিয়ে কমিশনার পদে নির্বাচিত হন।এরপরে তার ইচ্ছে হলো সাংসদ হবেন। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সং’সদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরণ না হওয়ায় আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি। মনোনয়নও পেয়ে যান।লালবাগ, হাজারীবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানা নিয়ে গঠিত নির্বাচনী এলাকায় বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন হাজী সেলিম। পুরান ঢাকায় শুরু হলো তার আধিপত্যের। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুর আশেপাশে থাকায় তার ব্যবসাও ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে, ১৯৯৯ সালেই তার প্রতিষ্ঠিত গ্রুপগুলোর টার্নওভার ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

সংবাদমাধ্যম এবং পুরান ঢাকার মানুষের অ’ভিযোগ, সাংসদ হবার পর থেকেই জমি ও বাড়ি দ’খলের নে’শায় মত্ত হন হাজী সেলিম। নিজের সং’সদীয় এলাকায় পঞ্চায়েত প্রথা চালু করেছিলেন তিনি, জমি বা বাড়ির বি’রোধ নিয়ে তার কাছে যারাই আসতো, তাদের কাছ থেকে সামান্য দামে সেসব জমি কিনে নিতেন তিনি, কেউ বিক্রি করতে না চাইলে জো’র করে উ’চ্ছেদ করা হতো। বুরিগঙ্গার পাড়ে ওয়াসার জায়গা দ’খল করে তিনি নিজের মালিকানাধীন পেট্রোল পাম্প স্থাপন করেছেন, সোয়ারীঘাটে নদীতীর দ’খল করে বানিয়েছেন কোল্ড স্টোরেজ।জগন্নাথ কলেজের (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্রাবাসের জায়গা দ’খল করে সেখানে বানিয়েছেন বিশাল শপিং কমপ্লেক্স, সেটার নাম গুলশান আরা প্লাজা। আরমানিটোলায় এক বৃ’দ্ধার সম্পত্তি দ’খল করে সেখানে গড়ে তুলেছেন এমসিসি টাওয়ার, নলগোলায় ভাওয়াল রাজার পারিবারিক সম্পত্তি দ’খল করে সেই জায়গায়ও ভবন তুলেছেন। শুধু তা-ই নয়, হাজী সেলিম চকবাজারের ফ্রেন্ডশিপ মার্কেট ও জে’লখানার পাশে পঞ্চাশ-ষাট বছরের পুরনো ব্যবসায়ীদের জো’রপূর্বক উ’চ্ছেদ করে সেখানে মদিনা আশিক টাওয়ার ও হাজী সেলিম টাওয়ার নামে দুটি বহুতল ভবন ও মার্কেট নির্মাণ করেন। মার্কেট নির্মাণের সময় ক্ষ’তিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের নতুন দোকান দেয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউকেই কোনো দোকান দেননি তিনি।

পুরান ঢাকার বাদামতলী, আরমানিটোলা, নবাববাড়ী, মিটফোর্ড রোড, নবাবপুর, ইমামগঞ্জ, ইসলামপুর, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, এমনকি নারায়ণগঞ্জের পাগ’লা বা ফতুল্লার মতো এলাকাতেও তার জমিজমা ও সম্পত্তি আছে। অনেকেরই অ’ভিযোগ, এসবের সিংহভাগই জো’র করে দ’খল করে নেয়া। কেউ যদি জমির অধিকার ছাড়তে না চাইতো, তার ও’পর নেমে আসতো অবর্ণনীয় নি’র্যাতন। হাজী সেলিমের মালিকানাধীন মার্কে’টের ভেতরে ট’র্চার সেলও পাওয়া গেছে, যেটা অপারেট করতো তার ছেলে ইরফান সেলিম।২০০১ সালে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরে গা ঢাকা দিয়েছিলেন হাজী সেলিম, তত্ত্বাবধায়ক স’রকারের আমলে পা’লিয়ে গিয়েছিলেন দেশের বাইরে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি তিনি, ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন নিজের এলাকা থেকে। এরপরে দক্ষিণ সিটি করপোর্শনের মেয়র পদে নির্বাচনের জন্যেও কিছুদিন দৌঁড়ঝাপ করেছিলেন, কিন্ত আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি। পরে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবেই ঢাকা-৭ আসন থেকে নির্বাচিত হন তিনি। তার ছেলে ইরফান সেলিম ২০২০ সালে ঢাকা দক্ষিণের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। হাজী সেলিমের প্রতিষ্ঠিত মদীনা গ্রুপের পরিচালকদের একজনও ইরফান সেলিম।

পুরান ঢাকায় হাজী সেলিম এবং তার পরিবারের সদস্যদের প্রচণ্ড প্রভাব। ক্ষ’তিগ্রস্ত বা নি’র্যাতিত হয়েও তাই এই পরিবারের বি’রুদ্ধে কথা বলতে চান না কেউ, মুখ খুলতে ভ’য় পায় সাধারণ মানুষ। খোদ আওয়ামী লীগও তাকে উপেক্ষা করতে পারে না। দেশের নানা প্রান্তে নামে-বেনামে সেলিম পরিবারের অনেক সদস্যের নামেই বাড়ি, ফ্ল্যাট এবং জমি আছে, এটা অনেকটা ওপেন সিক্রেটের মতোই। নৌবাহিনীর অফিসারকে মা’রধর করে সমালোচনার জন্ম দেয়ার পর এখন সেসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, দুদকও ত’দন্ত শুরু করেছে, মিডিয়া উৎসাহী হয়ে কালের অতল গর্ভ থেকে হাজী সেলিমের অতীত টেনে বের করছে। ইরফান সেলিমকে একটা ধন্যবাদ, রাগের মাথায় তিনি সেদিন রাস্তায় এই কাণ্ডটা না ঘটালে এই ওপেন সিক্রেটগুলো আর জানা হতো না আমাদের…তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা: বণিক বার্তা