পরিবহন শ্রমিক হয়েও সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন লুতু মিয়া

পেশায় পরিবহন শ্রমিক। সহায়-সম্পদ বলতে তেমন কিছুই নেই। নিজের ঘাম ঝরানো শ্রমে অর্জিত অর্থ দিয়েই কোনোরকমে সংসার চালিয়েছেন। তবুও থেমে থাকেননি অদম্য পরিশ্রমী এ বীর। ৭১-এ তরুণ বয়সে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেমনি জয় করেছেন দেশ, তেমনি পরবর্তীতে জীবনযুদ্ধেও সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছেন।সফল এই ব্যক্তি হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন লুতু। ‘লুতু মিয়া’ নামেই সবাই তাকে চেনে। বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার জারুলিয়া গ্রামে। ভারত সীমান্তবর্তী এ গ্রামেই কেটেছে শৈশব-কৈশোর। জাগো নিউজের কাছে তুলে ধরেছেন নিজের অনেক স্মৃতি ও জীবন সংগ্রামের কথা।

তিনি জানান, ১৯৭১-এ তিনি ছিলেন এসএসসি পরীক্ষার্থী। বয়স তখন ১৭। যুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক দিনের মাথায় এপ্রিলের শুরুর দিকে বাড়ির কাউকে কিছু না বলেই চলে যান দেশরক্ষার যুদ্ধে অংশ নিতে।রেমা চা বাগান হয়ে প্রথমে ভারতের বাঘাই এলাকায় যান। পরে বাল্লা ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এনামুল হক মোস্তফা শহীদের কাছ থেকে একটি লিখিত সার্টিফিকেট নিয়ে যান মৌলভীবাজারের কমলপুর ইয়ুথ ক্যাম্পে। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল ভারতের লোহারবন। সেখানে ২১ দিন প্রশিক্ষণ নেন। এরপর আরও ২১ দিন জুনিয়র লিডার উইং (জিএলডব্লিউ) প্রশিক্ষণ নিয়ে ৪নং সেক্টরের শ্রীমঙ্গলের কমলপুরে যুদ্ধ ক্যাম্পে যান।

সেখানে ভারত সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ধলাই বাগানে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন এ বীরযোদ্ধা। এটি তার প্রথম যুদ্ধ। পরে সেখান থেকে চলে যান ৩নং সেক্টরের ভারতের গমিশিং বাড়িতে। সেখানেও তিনিসহ মোট ১২ জনের একটি দল সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন।তিনি জানান, যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তারা চুনারুঘাট হয়ে চলে যান নবীগঞ্জে। সেখানে থানা দখলে নেন। ২৫ রাত ঘুমহীন অবস্থায় কাটিয়ে পাহারা দিয়েছেন। কয়েকদিন পর সেখান থেকে ১২ জন হবিগঞ্জ শহরে আসেন।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে এসএসসি পাস করে প্রথমে কয়েকদিন শিক্ষকতা করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। সেখান থেকে পরে পরিবহন শ্রমিকের কাজ নেন। পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের জনক এই যোদ্ধা শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাতে হিমশিম খান। এরপরও থেমে থাকেননি। পৌঁছেছেন সফলতার শীর্ষে।

প্রত্যেক সন্তানই আজ ভালো পর্যায়ে। বড়ছেলে কামাল হোসেন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে গণপূর্ত বিভাগে কর্মরত আছেন। দ্বিতীয় ছেলে তোফাজ্জল হোসেন লিটন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকর্ম বিভাগে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে প্রথমে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। তৃতীয় ছেলে দেলোয়ার হোসেনও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞান বিভাগে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। চতুর্থ ছেলে আফজাল হোসেন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লোক প্রশাসন বিভাগে এমএ ডিগ্রি অর্জন করে সোনালী ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন।

পঞ্চম ছেলে ইমতিয়াজ হোসেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। আর একমাত্র মেয়ে ফাতেমা বেগমকে বিয়ে দিয়েছেন প্রায় ২০ বছর আগে।৪২ বছর শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লুতু মিয়া। বর্তমানে প্রায় ১৩ বছর ধরে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। লিখছেন বই। ইতোমধ্যে তিনি ‘ঝড়’ ও ‘ঝলকানি মেঘের গর্জন’ নামে দুটি কবিতার বই লিখেছেন। লিখেছেন শিশুদের নিয়ে একটি বই।

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভালো নেই। কারণ যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধী ছিল তারা আজও সোচ্চার রয়েছে। দেশ অস্থিতিশীল করছে। যারা ক্ষমতায় আসে তারাই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি করে। আসল মুক্তিযোদ্ধা কতজন ছিল তা কেউ বলতে পারে না।’জীবনযুদ্ধে সফল বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার সফলতার কথা তুলে ধরে নিজেরাও গর্বিত বলে জানালেন তার বড়ছেলে প্রকৌশলী মো. কামাল হোসেন।

তিনি বলেন, আমরা গর্ববোধ করি এজন্য যে আমাদের বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যেমনি তিনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সফল হয়েছেন, তেমনি জীবনযুদ্ধেও সফল হয়েছেন। তিনি একজন পরিবহন শ্রমিক হয়েও আমাদের অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। অভাবের সংসারে মা আমাদের সবসময় পড়ালেখার প্রতি জোর দিয়েছেন। আজ আমরা মানুষ হয়েছি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। আমরা চাই এখন আমাদের বাবা-মা যেন এখন সুখে থাকেন।