দরিদ্র পরিবারের পিংকির বিয়েতে বাবার দায়িত্বে ডিআইজি দেবদাস

আর দশটি জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের মতোই ছিল আয়োজন। বিয়ের অনুষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এসেছিলেন।গত মঙ্গলবার (৩ মে) রাতে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত কামারপাড়া গ্রামে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য সস্ত্রীক উপস্থিত থেকে সনাতন ধর্ম রীতি মেনে বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করে দরিদ্র পরিবারের মেয়ে শ্রাবণী রানী রায় পিংকির বিয়ে সম্পন্ন করেন। ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্যে্যর এই মানবিকতা ও উদারতায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে পিংকির পরিবার ও এলাকাবাসী।

জানা গেছে, শ্রাবণী রানী রায় পিংকির বাবা অতুল চন্দ্র রায়ের জেলার ডিমলার চাপানিহাটে বড় মিষ্টির দোকান ছিল। তাদের সংসারে সচ্ছলতা ছিল। হঠাৎ ২০০৩ সালে পিংকির বাবার মৃত্যুতে সংসারে নেমে আসে দুর্যোগ। পিংকির মা রঞ্জু রানী রায় ছোট্ট তিন মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ভাইদের বাড়ির এক অংশে ঘর তুলে কোনো মতে সংসার চলতো পিংকিদের। এক সময় আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় পিংকির বড় বোন শিল্পী রানী রায়ের বিয়ে হয়। ছোট বোন প্রীতি রানী রায় স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর পিংকি রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইংরেজিতে অনার্সে ভর্তি হয়ে টিউশনি করে পড়াশুনা চালাতো। মহামারি করোনায় তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে পিংকিকে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্যের কাছে পাঠান শিক্ষানবিশ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী দিলীপ কুমার রায়।

পিংকি ডিআইজির কাছে স্নেহের প্রশ্রয় পেয়ে বাবা ডাকার সম্মতি পান। গত মঙ্গলবার রাতে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য সস্ত্রীক উপস্থিত থেকে সনাতন ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করে কিশোরগঞ্জ উপজেলার বড়ভিটা মেলাবর টটুয়ার ডাংগা এলাকার বিনোদ চন্দ্র রায়ের ছেলে প্রদীপ কুমার রায়ের সঙ্গের পিংকির বিয়ে সম্পন্ন করেন।

পরে ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করে পিংকির বিয়েতে বাবার দায়িত্ব পালন করার বিষয়টি উল্লেখ করেন। সেই পোস্টে তিনি লিখেন, পিংকি আমার কাছে স্নেহের প্রশ্রয় পেয়ে বলে, অনেক আগে আমার বাবাকে হারিয়েছি। আপনাকে বাবা বলে ডাকি? আমার সম্মতিতে আমাকে সে বাবা বলে ডাকে। মঙ্গলবার অক্ষয় তৃতীয়া তিথিতে মেয়েটির বিয়ে হল। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছে। বিয়েতে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলাম। দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের ম্লানমুখ আমাকে ব্যথিত করে। পিংকি এবং তার বরের জন্য অনন্ত শুভ কামনা।

কনে শ্রাবণী রানী রায় পিংকিং ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার যখন ছয় বছর বয়স তখন বাবা মারা যান। মামাদের সাহায্য সহযোগিতায় কষ্ট করে মা আমাদের বড় করেছেন, লেখাপড়া করিয়েছেন। করোনাকালে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর দিলীপ আংকেল ডিআইজি স্যারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমার বাবা না থাকায় আমি ডিআইজি স্যারকে বাবা ডাকার আবদার করলে তিনি সম্মতি দেন। এর মাঝে আমার বিয়ে ঠিক হয়। আমার বিয়েতেও উনি অনেক খরচ বহন করেছেন। আমি কল্পনাও করিনি উনি আমার বিয়েতে এসে আমার বাবার দায়িত্ব পালন করবেন। জীবনের সব থেকে বড় পাওয়া এটাই। হয়তো এ রকম বড় প্রাপ্তি কখনো হবে না। আমার পরিবারের সবাই অনেক খুশি। সবার দোয়া ও আশীর্বাদ কামনা করছি।

বর প্রদীপ কুমার রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার জীবন ধন্য। এটা কখনো ভাবিনি শ্বশুর হিসেবে ডিআইজি স্যারকে পাব। এটা আমার জীবনের বড় পাওয়া। বিয়ের আগে আমার পরিবারের সবাই বলেছিল যে শ্বশুর নাই, বিয়ে করে কী পাবি। এখন আমার পরিবার আত্মীয়-স্বজন সবাই খুশি। কারো কোনো আপত্তি নেই শ্রাবণীর পরিবার নিয়ে।পিংকির কম্পিউটার শিক্ষক রঘুনাথ সিংহ রায় ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি রাজ পরিবারের বিয়ে দেখিনি, কিন্তু একটা জীর্ণ বাড়িতে রাজকীয় বিয়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলাম। সেদিন থেকে অনেক কথাই ভাবছি। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব তা নির্ণয় করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এতটুকু বলবো পিংকির পূর্ব জন্মে অনেক অনেক সুকর্ম ছিল। আর আমার জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি হলো মানুষ রূপে দেবতার দর্শন পাওয়া। বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন নীলফামারীর পুলিশ সুপার মোখলেছুর রহমান, মানবাধিকারকর্মী দিলীপ কুমার রায়, রঘুনাথ সিংহ রায় প্রমুখ।