একজন সফল মানুষকে শুরুতেই নানা বাধা পেরোতে হয়। কখনো আর্থিক সঙ্কট, কখনো সামাজিক সমস্যা। কাছের মানুষদের থেকেও অনেকে কষ্ট পেয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে বন্ধু বা পরিচিত মহল থেকে নানা বিদ্রুপের শিকার হতে হয়। এমন নানা বাধা ও বিদ্রুপের শিকার হতে হয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু ইউসুফকে।আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ২০১৯ সালে আবু ইউসুফ ছিলেন চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবা-মায়ের দেয়া অর্থেই পড়ালেখা চলছিল। কিন্তু পরিবার অর্থের চাপ থেকে মুক্ত রাখতে কী করা যায় সেই উপায় খুঁজছিলেন ইউসুফ। প্রথমে টিউশনি খোঁজার চেষ্টা করেন। টিউশনি খুঁজতে লিফলেটও বিলিয়েছিলেন।
টিউশনি খোঁজার এই চেষ্টায় অবশ্য একটি টিউশনি পেয়েছিলেন ইউসুফ। কিন্তু সেখানে থাকতে হবে লজিং মাস্টার হিসেবে। সেটি আবার ক্যাম্পাস থেকে বেশ দূরে। এই শর্ত মানেনি ইউসুফের মন। শেষ পর্যন্ত মনের সিদ্ধান্তেই টিউশনি ছেড়ে দেন তিনি।তবে টিউশনির চেষ্টা ছেড়ে দিলেও থেমে থাকার পাত্র নন তিনি। ভাবতে থাকেন ব্যতিক্রম কিছু করার। তরুণ মন তাকে টানতে থাকে ব্যবসার দিকে। ক্যাম্পাসে ও আশপাশের এলাকায় শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা।
গেল বছরের ২ নভেম্বর লালন শাহ হল থেকে ‘হালাল শপিং জোন’ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেন। এসময় নিজের পুঁজি ছিল মাত্রা ২ হাজার টাকা। মায়ের কাছ থেকে নেন ১ হাজার টাকা। আর বন্ধুর থেকে ঋণ নেন ২ হাজার টাকা। মোট ৫ হাজার ২০৯ টাকায় শুরু হয় ‘হালাল শপিং জোন’।ইউসুফের সঙ্গে কথা হয় সময় নিউজের। শুরুর সময়ে প্রতিকূলতা নিয়ে বেশ দুঃখ রয়েছে তার মনে। ইউসুফের ভাষায়, প্রাথমিক পর্যায়ে যখন ব্যবসা শুরু করি তখন কাছের অনেক মানুষ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা তামাশা-ঠাট্টা করত। তখন বেশ মন খারাপ হত। কিন্তু অন্যের কথায় কান দিয়ে নিজের ক্ষতি না করতে নিজের কাজটা চালিয়ে যাই।
তবে যেমন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হয়েছেন তেমনি সহায়তা পেয়েছেন অনেক কাছের মানুষের কাছ থেকে। বেশ কিছু বন্ধু ও ক্যাম্পাসের সিনিয়ররা তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। নিজ বিভাগের একাধিক শিক্ষাকের কাছ থেকেও উৎসাহ পেয়েছেন তিনি।ইউসুফের আইডল হচ্ছে আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত শেখ আকিজ উদ্দিন। ইউসুফ বলেন, আকিজ স্যারের গল্প আমি জানি। উনি মাত্র ১৬ টাকা নিয়ে রেলস্টেশনের একজন সামান্য ফেরিওয়ালা ছিলেন। তাঁর চেষ্টা তাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে তা মনে করে আমিও চেষ্টা করছি। তখন কেউ নেতিবাচক কিছু বলে আমি তখন ভাবি, আকিজ স্যার অনেক বড় কিছু করেছে। আমি অত বড় না পারলেও ছোট কিছুতো পারবো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় অনেক আগে থেকেই সকালে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস রয়েছে। সেই অভ্যসটা কাজে লাগালেন ইউসুফ। ভোরে উঠেই চলে যেতেন কুষ্টিয়ার পোড়াদহে। পছন্দের পোশাক পাইকারি নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরতেন। সকাল ৯টায় ক্লাসে যেতে হবে। তাই পোশাকগুলো রুমে রেখে ক্লাসে চলে যেতেন। ক্লাস শেষ করে ক্যাম্পাসেই বিক্রি করতেন পোশাক।কিন্তু চলতি বছর করোনার কারণে মার্চ মাসে যখন ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায় তখন হতাশ হয়ে পড়েন ইউসুফ। ভাবলেন এই বুঝি ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। ক্যাম্পাস ছেড়ে ফিরতে হল বগুড়ায় নিজ বাড়িতে। ব্যবসা আপাতত বন্ধই রইল।
কিন্তু এর মধ্যেই খোঁজ পান অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায়ী গ্রুপ ‘বগুড়া বিজনেস গ্রুপ’ (বিবিজি)-এর। গ্রুপে বিনামূল্যে তার পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু করলেন। দ্রুত ভালো সাড়াও পেলেন। এবার ইউসুফ আর একা নন। সঙ্গে নিলেন এলাকার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের। অনলাইনে বিনা পুঁজিতে ব্যবসার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এসব শিক্ষার্থীদের পেয়ে যান ইউসুফ। শুরু হয় ইউসুফের নতুন যাত্রা।
এবার আর শুধু কুষ্টিয়া বা বগুড়া এলাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ইউসুফ ব্যবসা ছড়িয়ে দেন। বর্তমানে ‘হালাল শপিং জোন’এর পণ্য ৪২টি জেলায় যাচ্ছে। তার সঙ্গে কাজ করছেন ৪০ জন তরুণ।‘হালাল শপিং জোন’ থেকে গড়ে মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার পোশাক বিক্রি করছেন ইউসুফ ও তার সহযোগীরা। তবে করোনার পর বিক্রি দ্বিগুণ হবে বলে আশা করেন তিনি।