ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মাহমুদা আফরোজ লাকী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে যোগ দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জে সহকারী জজ হিসেবে। তিনি নারায়ণগঞ্জের প্রথম নারী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট।পরে ২০১০ সালে বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে এএসপি হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে। দায়িত্ব পালন করেছেন ডিএমপি সদর দফতর, মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে। পুলিশের সর্বোচ্চ পদকসহ (পিপিএম) নানান পুরস্কার পাওয়া লাকী বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন ডিএমপির মিরপুর বিভাগের দারুস সালাম জোনের এডিসি হিসেবে।বাবা-মা দুঃখ না করলেও আত্মীয়-স্বজনের মনে খুব বেশি দুঃখ ছিল। সবসময়ই শুনতে হতো তিনটাই মেয়ে, বিয়ে হলে চলে যাবে। বুড়ো বয়সে বাবা-মাকে কে দেখবে? বিয়ের পর সব সম্পত্তি অন্যের ছেলেরা পাবে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন লাকী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক তৌহিদুজ্জামান তন্ময়
মাহমুদা আফরোজ লাকী: গল্পটা অনেক বড়। আমরা তিন বোন, কোনো ভাই নেই। ভাই নেই বলে বাবা-মা দুঃখ না করলেও আত্মীয়-স্বজনের মনে খুব বেশি দুঃখ ছিল। সবসময়ই শুনতে হতো তিনটাই মেয়ে, বিয়ে হলে চলে যাবে। বুড়ো বয়সে বাবা-মাকে কে দেখবে? বিয়ের পর সব সম্পত্তি অন্যের ছেলেরা পাবে। আত্মীয়-স্বজনদের এ বিষয়টা ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে একটু কষ্ট দিত। এটা একরকম জিদই বলতে পারেন। তখন থেকেই ভেবেছি, এমন কিছু করবো যেন কেউ কখনো বাবার নাম ধরে বলতে না পারে, তার কোনো ছেলে নেই।এরপর নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা জিদ ছিল। সবসময়ই মনে হতো, এমন কিছু করবো, যা একটা ছেলে করতে পারে। আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে আমি সহকারী জজ হিসেবে যোগদান করেছিলাম নারায়ণগঞ্জে। কিন্তু তারপরও মন মানেনি। মনে হয়েছে, আরও এমন কিছু করা দরকার, যেটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। মনের সেই জিদটাই এতোদূর নিয়ে এসেছে।
আমি পুলিশে কাজ করছি, দিন-রাত খাটছি, এটা দেখে সবাই আনন্দিত হয়। মানুষ এই লাকীকে দেখে খুশি হচ্ছে, কিন্তু তার স্ত্রী বা তার ছেলের বউ বাইরে কাজ করবে, এটা তারা মেনে নিতে পারছে না আরেকটা বিষয় ছিল, আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতাম। সেসব গল্প শুনে মুক্তিযুদ্ধে যেতে না পারার আক্ষেপ কাজ করতো। সবসময় মনে হয়েছে দেশের জন্য কিছু করতে হবে, মানুষের জন্য কিছু করতে হবে। যেখান থেকে সরাসরি মানুষের জন্য কিছু করা যায়, মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। বর্তমানে আমরা যতোটা সুন্দরভাবে ভাবতে পারছি, আমাদের আগে এটা ভাবা হয়নি। সেজন্য একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। ওই গ্যাপটাই আমরা এখনো পূরণ করেই যাচ্ছি। সেজন্য যে ক্ষেত্রগুলোতে নারী সংখ্যা কম কিন্তু প্রয়োজন বেশি, সে জায়গাগুলোতে কোটা দিতে হবে। কোটার মাধ্যমে সংরক্ষিত আসন দিয়ে প্রথমে নারীদের এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমরা এই গ্যাপটা পূরণ করতে পারবো।দেখা গেছে, সারাদিন এমন কোথাও দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে হয় যেখানে কোনো পাবলিক টয়লেট নেই। এটা মেয়েদের জন্য খুবই কষ্টের
মাহমুদা আফরোজ লাকী: যতোটা চেয়েছিলাম ততোটা সম্ভব হয়নি, এটা যেমন সত্য তেমনি এটাও মানতে হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যতটুকু করেছেন, আমার বিশ্বাস এভাবে অনেক উন্নত দেশও করতে পারেনি। তবে এটা শুধু একা সরকারের বা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি, এটা দুঃখের বিষয়। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কিন্তু চেষ্টার কমতি নেই। এখন নারীর অংশীদারত্ব এসেছে, কিন্তু ক্ষমতায়ন বলতে আমরা যেটা বুঝি ডিসিশন মেকিং বা নেতৃত্বের কথা, সেক্ষেত্রে সব জায়গায় এখনো নারী যেতে পারছে না। সেজন্য নারী-পুরুষ সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে।আমি শুধু একজন অফিসার নই, একজন মা, একজন স্ত্রী। আমাকে অফিসের কাজের পাশাপাশি আমার পরিবার-সন্তানকে সময় দিতে হয়। পুলিশে আমাদের কাজ ২৪ ঘণ্টার। রাত ২টার সময়ও কোনো দরকারে আমাকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। আবার প্রয়োজনে গভীর রাত পর্যন্ত আমাকে বাইরে থাকতে হচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য এই চ্যালেঞ্জটা নিতেই হয়। কিন্তু আমি দেখেছি একজন নারী কসাই, একজন ভ্যানচালক, রিকশাচালক। তারা তাদের সংসার-পরিবার বাঁচানোর জন্য যে যুদ্ধ করছে, আমাকে সেটা করতে হচ্ছে না। আমি তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হই। আমি এভাবে দেখি, তারা যেহেতু এসব পারছে তাহলে আমরা মেয়েরা কেন পারব না?
মার্চ মাস বাঙালি জাতির জন্য গৌরবের মাস। ৮ মার্চ নারীদের জন্য আরও বেশি গৌরবের ও আনন্দের। অনেকে বলে, এই একদিনে সভা-সমিতি করে কী হবে? আমি এটাকে ভিন্নভাবে দেখি। আমি মনে করি এই একটা দিন হচ্ছে নতুন করে শপথ গ্রহণ করার, নতুন করে কার্যক্রম গ্রহণ করার দিন।এ বছর ৮ মার্চ আমি নতুন কিছু টার্গেট করব, আগামী ৮ মার্চের আগে সেসব পূরণ করব। আগামী ৮ মার্চ আমরা পেছনে তাকিয়ে দেখবো কতটুকু করতে পেরেছি, এ থেকে আমাদের কী কী ভুল ছিল, কী কী করার ছিল, নতুন ৮ মার্চ আমরা নতুন আরেকটা টার্গেট নেব। আমার মনে হয় এভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই এই ৮ মার্চ।একটা মেয়ের ব্যক্তিগত দায় যতটুকু, সমাজ বা তার পরিবারকেও কিন্তু দায়বদ্ধ না করার সুযোগ নেই। একটা মেয়ের মধ্যে কিছু করার জিদটাও থাকতে হবে, পরিবারকেও বুঝতে হবে। বিয়ের আগেই যদি বলে দেয়া হয়, আমি সব করব কিন্তু আমাকে কাজ করতে দিতে হবে। আমি জন্মেছি এতদূর পড়াশোনা করেছি, জন্মেছি কাজ করার জন্য, ঘরে বসে থাকার জন্য নয়। তাহলে সমস্যাটা অনেকটাই সমাধান হয়।আমি পুলিশে কাজ করছি, দিন-রাত খাটছি, এটা দেখে সবাই আনন্দিত হয়। মানুষ এই লাকীকে দেখে খুশি হচ্ছে, কিন্তু তার স্ত্রী বা তার ছেলের বউ বাইরে কাজ করবে, এটা তারা মেনে নিতে পারছে না। এখানে পরিবার ও সমাজের কিছু দায় থেকে যাচ্ছে। আমাদের সবারই এজন্য চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
মাহমুদা আফরোজ লাকী: দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে পুলিশের সংখ্যা কম থাকার কারণে আমাদের ডিউটি করতে হয় অনেক বেশি। আসলে আমরা কখন যাচ্ছি আর কখন ফিরব সেটা ঠিক করতে পারছি না। আরেকটা বিষয় আমাদের পরিবেশ। আমাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় ডিউটি করতে হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে পথে-ঘাটে কাজ করতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে ভালো ফ্রেশরুমের ব্যবস্থা থাকে না।দেখা গেছে, সারাদিন এমন কোথাও দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে হয় যেখানে কোনো পাবলিক টয়লেট নেই। এটা মেয়েদের জন্য খুবই কষ্টের।আবার বাড়ির মেয়েটা পুরুষের মতো পোশাক পরে ডিউটি করবে, এটা অনেকে মেনে নিতে পারেন না। যার ফলে পরিবার থেকেও অনেক সময় মেয়েদের এই পেশায় আসতে দিতে চায় না।প্রথমে বলবো- হতাশ হওয়া যাবে না। আজকে আমাকেও এ পর্যায়ে আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। চলতে গেলে পথে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিবন্ধকতা আসবে। কিন্তু সবসময় মনে রাখতে হবে আমি এগিয়ে যেতে চাই, এজন্য আমাকে পরিশ্রম করতে হবে, মেধা খরচ করতে হবে। এটা করতে পারলে অবশ্যই সে এগিয়ে যাবে। এর আগে আমি যখন গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে ছিলাম তখন একাই লেডি অফিসার ছিলাম। সেখানে মেয়ে কনস্টেবলরা কাজ করতো, সুযোগ পেলেই তাদের সঙ্গে কথা বলতাম। কারণ আমি জানি মেয়েগুলো বাইরে কাজ করছে, তাদেরও নানারকম ফ্যামিলি ক্রাইসিস আছে। সবসময় ওদের আমি মোটিভেট করার চেষ্টা করতাম। আমি ডিএমপির ট্রেনিং একাডেমিতে নিয়মিত ক্লাস নিই। সেখানে আমি সবসময় সবাইকে মোটিভেট করার চেষ্টা করি। ছেলেদের শেখাই মেয়েদের প্রতি কিভাবে আরেকটু শ্রদ্ধা দেখানো যায়। এছাড়া, থানাগুলোতে আমি নিয়মিত ব্রিফ করি।
বর্তমান সময়ে একটা অস্থিরতা দেখি সবার মধ্যে। অল্প সময়ের মধ্যে ওপরে উঠতে হবে। সেলিব্রেটি হতে হবে, ভালো বেতনে চাকরি পেতে হবে—এমন প্রবণতা। এ জায়গাটা থেকে একটু সরে গিয়ে সবাইকে একটু স্থির হতে হবে। নিজের ভেতর চিন্তার গভীরতা আনতে হবে।পাশাপাশি সাবধান থাকতে হবে। কাউকে অন্ধ বিশ্বাস করা যাবে না, সে যতো কাছেরই হোক। আমি মনে করি, মা ছাড়া পৃথিবীতে অন্ধ বিশ্বাস করার মতো আর কোনো মানুষ হয় না। আমি যাকে ভালোবাসছি আজ, কালকেই যে শত্রু হয়ে দাঁড়াবে না, সে ভরসা কিন্তু নেই। তাই কাউকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করে আমার ব্যক্তিগত বিষয়, গোপনীয় বিষয়গুলো কারও সঙ্গে শেয়ার না করে সাবধান থাকতে হবে।পাবলিক জায়গাগুলোতে, ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কতটুকু কি প্রকাশ করা যাবে, এ বিষয়টা প্রত্যেকেরই আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে করা উচিৎ। ব্যক্তিগত ছবি কাউকে শেয়ার করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এগুলোই পরবর্তী জীবনে ক্ষতির কারণ হতে পারে।যৌতুকের জন্য নির্যাতন, ধর্ষণের মতো কিছু অভিযোগ ছাড়া সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগগুলো পাচ্ছি সেটা সাইবার রিলেটেড। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও সঙ্গে ছবি শেয়ার করা, কোনো ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও করা হয়েছে, পরে সেটা দিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করা হচ্ছে। এ ধরনের অভিযোগ বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পেয়ে থাকি।