সেই চারুবালাকে ঘর করে দিল পুলিশ, এমপি নিক্সন দিলেন লাখ টাকা

স্বাধীনতাযুদ্ধে স্বামী-সন্তান ও সম্ভ্রম হারানো অশীতিপর সেই বৃদ্ধা চারুবালাকে বসবাসের জন্য একটি সেমিপাকা টিনের ঘর করে দিয়েছেন ফরিদপুর জেলা পুলিশ। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার গাজিরটেক ইউনিয়নের পদ্মানদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল রমেশবালা গ্রামে নির্মিত ওই ঘরটি রোববার (২ মে) বিকেল ৩টার দিকে তার হাতে হস্তান্তর করেন ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন।

মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নিহত হন চারুবালার স্বামী চন্দ্রকান্ত বিশ্বাস। এরপর পর থেকে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে শহরের টেপাখোলা বাজারে শাকসবজি বিক্রি করে কোনোরকম দিনযাপন করেছেন এই নারী। সম্প্রতি জেলার শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির মাধ্যমে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামান তার দৈন্যদশা জানতে পেরে এই বাড়ি তৈরি করে দেন।

ঘর হস্তান্তর অনুষ্ঠানে এমপি মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার আলিমুজ্জামানের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, এই করোনাকালে পুলিশ সদস্যদের বেতনের টাকা থেকে এমন একজন মানুষকে ঘর করে দেয়া হলো। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে বলেই দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের প্রজন্মদের সম্মানিত করা হচ্ছে। এসময় তিনি চারুবালাকে নগদ এক লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন।সেই চারুবালাকে ঘর করে দিল পুলিশ, এমপি নিক্সন দিলেন লাখ টাকা

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সামসুল হক ভোলা, চরভদ্রাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাকারিয়া হোসেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সম্পাদক আনোয়ার আলী মোল্যা, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মাহফুজুর রহমান মুরাদ, এস এম ফরহাদ, লুৎফর রহমান প্রমুখ বক্তব্য দেন।এসময় ওই গ্রামে মসজিদের জন্য দুই লাখ টাকা এবং মন্দিরের জন্য এক লাখ টাকা অনুদানের ঘোষণা দেন ফরিদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। এছাড়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে চারুবালাকে ২০ হাজার টাকা অনুদানের ঘোষণা দেয়া হয়। এলাকাবাসী তাদের রাস্তাঘাট ও বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য সংসদ সদস্যের প্রতি বিশেষ আবেদন জানান।

এর আগে গত ১৯ এপ্রিল বিকেলে রমেশ বালারডাঙ্গির ভাঙা ঘরে অসুস্থ চারুবালাকে (৬৭) দেখতে যান ওসি জাকারিয়া হোসেন। সঙ্গে ছিলেন থানার সেকেন্ড অফিসার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফিরোজ আলী মোল্লা এবং এসআই আওলাদ হোসেন। চরভদ্রাসন উপজেলার গাজীরটেক ইউনিয়নে পদ্মানদীর অপর পাড়ের দুর্গম চর রমেশ বালারডাঙ্গিতে বসবাসরত চারুবালা পুলিশের পক্ষ থেকে এক ঝুড়ি ফল পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।

চারুবালা বলেন, ‘৫০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন আমার স্বামী চন্দ্রচরণ বিশ্বাসকে গুলি করে মারে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা। আমার কোল থেকে কেড়ে নিয়ে দুই বছরের শিশু পার্বতীকে উঠানের ওপর আছড়ে মেরে ফেলে। পরে আমাকে নির্যাতন করে ও সম্ভ্রমহানি ঘটায়। সেই দিনের সেই করুণ দৃশ্য আমি কোনো দিনও ভুলতে পারব না।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধে স্বামী ও শিশুসন্তান হারিয়ে চারুবালা পদ্মানদী থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে দুর্গম বালুচর ও ফসলি মাঠের জমির মধ্যে ভাই সিদ্ধিচরণ সরকারের আশ্রয়ে তার বসতভিটের উত্তর পাশে ছনবন ও পাটখড়ি দিয়ে গড়া একটি ভাঙা ঘরে থাকতেন।ওসি জাকারিয়া হোসেন বলেন, ‘শহীদ পরিবারের সদস্য এবং বীরাঙ্গনা বাংলা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পেরে আমি ও আমার সহকর্মীরা গর্বিত। ভবিষ্যতে তার সহায়তার জন্য যা যা করা দরকার তাই করা হবে।’

ফরিদপুর জেলা শহীদ স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি শেখ সাজ্জাদুল হক সাজ্জাত বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হায়েনারা চারুবালার স্বামী ও শিশুসন্তানকে মেরে ফেলে। তাকে ধর্ষণ করে ও বাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার পর ওই দুর্গম চরাঞ্চলে বীরাঙ্গনা চারুবালা অসহায় অবস্থায় একা একা ৫০টি বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। আমরা তাকে খুঁজে বের করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’এদিকে সম্প্রতি ১৯৭১ সালে যুদ্ধে স্বামী, সন্তান ও সম্ভ্রম হারানো চারুবালার বীরাঙ্গনা স্বীকৃতির জন্য ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অতুল সরকার একটি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন।