পিঁপড়ার ডিমে চলে ৪০ পরিবার

কালিয়াকৈর-শ্রীপুর আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশেই শালবন। মজিদচালা এলাকায় একদিন দেখা যায়, একটা লম্বা বাঁশ ও থলে হাতে এক যুবক গাছে গাছে কী যেন খুঁজে ফিরছেন। তার কাছে গিয়ে জানা গেলো, তিনি লাল পিঁপড়ার বাসা খুঁজে খুঁজে সেই বাসা থেকে পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করেন।শালবন থেকে সাদা রঙের ডিম সংগ্রহ করা ওই যুবক হলেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার জানপাড়া এলাকার নিমাই চন্দ্রের ছেলে পলাশ চন্দ্র (৩৫)। তার মতো একই এলাকার নিখিল, নিটোর, মানিক চন্দ্র ও পরিমলসহ আরও ৪০ জন আছেন। তারা লাল পিঁপড়ার ডিম প্রতি কেজি ৮০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেন। এ দিয়েই চলে তাদের সংসার।

লাল পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহকারী পলাশ বলেন, সব পিঁপড়ার বাসায় ডিম পাওয়া যায় না। চাই লাল পিঁপড়ার বাসা। যেখানে মিলবে প্রচুর পরিমাণ সাদা রঙের ডিম। এই পিঁপড়ার ডিমই যে তার জীবিকা নির্বাহের হাতিয়ার। সাধারণত রইনা, মেহগনি, আম, লিচুসহ দেশীয় গাছগুলোতেই লাল পিঁপড়ার বাসা পাওয়া যায়। তবে আমাদের এখানে শালবনে গাছের ডালের আগার দিকের চার-পাঁচটা পাতা মুখের লালা দিয়ে জোড়া দিয়ে শক্ত বাসা তৈরি করে পিঁপড়ার দল। ওই সব বাসা থেকেই ডিম পাওয়া যায়। বড় বাসা থেকে ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম ডিম পাওয়া যায়। এই ডিম সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজটি খুব সতর্কের সঙ্গে করতে হয়। ডিমগুলো মাছের খাবার হিসেবে বিক্রি হয়। ডিম আস্ত না রাখলে মাছ খায় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শালবন বা বিভিন্ন দেশীয় গাছ থেকে পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করা হয়। বন ও গ্রাম থেকে ডিম সংগ্রহ করে জীবন্ত ডিম বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন তারা। প্রচণ্ড গরমে পিঁপড়ার ডিম নষ্ট হয়ে যায়। ডিম ছায়াযুক্ত স্থানে বাঁশের খাঁচায় টানিয়ে রাখা হয়। এক ধরনের বড় লাল পিঁপড়া বনাঞ্চলের মেহগনি, গজারি, শালসহ বিভিন্ন গাছের কিছু পাতা দিয়ে গোলাকার বাসা বানিয়ে ভেতরে অসংখ্য ডিম ছাড়ে। পিঁপড়ার ডিম ব্যবসায়ীরা বাঁশের মাথায় ডালি বেঁধে সে ডিম পেড়ে আনেন।

মজিদচালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হালিম বলেন, উপজেলার ফুলিবাড়িয়া ইউনিয়নের নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রায় ৪০টি পরিবার লাল পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে। সেগুলির ক্রেতা হচ্ছে বরশি দিয়ে সৌখিন মাছ শিকারিরা। গ্রামের যারা পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে তাদের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার জন্য বেপারি আছেন। বেপারিরা কিনে নিয়ে গাজীপুর জেলা শহরে আবার কেউ কেউ ঢাকায় নিয়েও বিক্রি করে থাকেন। পানির নির্দিষ্ট স্থানে আধার ফেলে মাছ ডেকে আনার জন্য এই ডিমের চাহিদা রয়েছে জেলেদের কাছেও। এজন্য অনেক সময় জেলেরা তাদের কাছ থেকে ডিম কিনে থাকেন।

বড়ইবাড়ি এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আজাদ মিয়া বলেন, দুইটি গ্রামের কিছু কুচ বংশের লোকের বসবাস রয়েছে। তাদের অধিকাংশই দরিদ্র। এই কাজে কোনো পুঁজি লাগে না বললেই চলে। এজন্য তারা এটাকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসাবে বেঁছে নিয়েছেন। সারাদিনে একেকজন এক থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করতে পারেন। আর তাই দিয়েই ছেলে-মেয়ে নিয়ে তাদের সংসার চলে।

পিঁপড়ার ডিম ব্যবসায়ী উপজেলার কালিয়াকৈর উপজেলার ফুলবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা কালিপদ দাস বলেন, যখন মাছ শিকারের ধুম পড়ে যায়, তখন প্রতি কেজি পিঁপড়ার ডিম দেড় হাজার টাকায়ও বিক্রি হয়। এ ডিম মাছ শিকারি ছাড়াও ঢাকা শহরের সৌখিন মাছ শিকারিরা কেনেন। হারাদন বলেন, তিনি প্রতিদিন গড়ে দুই কেজি পিঁপড়ার ডিম বিক্রি করেন। তবে, বর্ষাকাল চলে গেলে ডিমের চাহিদা কমে আসে।পিঁপড়ার ডিম শিকারি বিকাশ চন্দ্র জানান, এক সময় পিঁপড়ার ডিম সারাদিন সংগ্রহ করে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা বিক্রি করা যেত। এখন সারাদিন পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা বিক্রি করেন। তিনি প্রায় দশ বছর ধরে পিঁপড়ার ডিম সংগ্রহ করছেন।