মিশরের রাস্তায় হাজার বছর আগের রাজা-রানিরা

আলোয় আলোয় ঝলমল করছে প্রাচীন মিশরের কায়রো নগরের রাজপথ। আর তার ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে এক বিশাল শোভাযাত্রা।রাস্তার দুই পাশে প্রাচীন মিশরের রাজকীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী শ্রদ্ধা জানানোর জন্য হাজির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সবার হাতে রাজা-রানিদের জন্য উপহার। আছে ঘোড়ায় টানা রথ আর তাতে দাঁড়িয়ে থাকা রাজকীয় পোশাক পরিহিত সেনা। যেন সদ্য মৃত কোনো মিশরীয় রাজা কিংবা রানির শেষযাত্রার অনুষ্ঠান।

শোভাযাত্রার আগে হেঁটে যাচ্ছে এক ঝাঁক সুন্দরী মিশরীয় অপ্সরী। তাদের হাতেও রাজা-রানিদের জন্য বিশেষ উপহার। প্রত্যেকের গায়ে প্রাচীন মিশরের রাজকীয় রমণীদের পোশাক। তাদের পরেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে কারুকার্যময় রাজকীয় কফিন বহনকারী গাড়ি। আর সোনালী রঙের এসব রাজকীয় কফিনে শুয়ে আছেন হাজার বছর আগের মিশরীয় রাজা-রানিরা! এ কোনো হলিউডের চলচ্চিত্রের দৃশ্য নয়, একেবারে বাস্তব।

কায়রোর রাস্তায় এমনটা যে ঘটতে যাচ্ছে, তা হয়তো অনেকের জানাই ছিল। তবে বাস্তবে এর রুপ যে কতটা মোহনীয় তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তবে রোববার মিশরবাসীরা ঠিকই এই দৃশ্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উপভোগ করলো। যদিও এতে খরচ হয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। গান স্যালুটের মাধ্যমে রোববারের অনুষ্ঠানের শুরু হয়। এরপর চলে আলো ও সঙ্গীতের খেলা। যেখানে অংশ নেন দেশটির তারকা শিল্পীরা।

মিশরের মোট ১৮ জন রাজা ও ৪ জন রানির মমি এই শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। মূলত এই মমিগুলোর বাসস্থান পরিবর্তিত হয়েছে। তাদের আগের ঠিকানার চেয়ে ৫ কিলোমিটার দূরে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন জাদুঘর। যার নাম ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ইজিপশিয়ান সিভিলাইজেশন’। এই নতুন জাদুঘরটাই এখন তাদের নতুন ঠিকানা। আর তাদের নতুন ঠিকানায় পৌঁছে দিতেই এই শোভাযাত্রার আয়োজন। শোভাযাত্রায় শাসনকালের ক্রম অনুযায়ী শাসকদের মমি নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিটি কফিনে বাতাস নিরোধকের ব্যবস্থা ছিল।

মমিগুলো ১৮৮১ থেকে ১৮৯৮ সালের মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছিল। মিশরে এই মমিগুলোকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে এই শোভাযাত্রা উপলক্ষে নেওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। মমি বহনকারী গাড়িগুলো ঘিরে ছিল আরও কয়েকটি মোটরগাড়ি। মমিগুলোর কনভয় মিশরের জাতীয় জাদুঘর (ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম) থেকে তাহরির স্কয়ার দিয়ে একই শহরের ফুস্তাতে অবস্থিত নতুন জাদুঘরে পৌঁছায়।

মমিগুলোকে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে ভ্যালি অব কিংস এবং দেইর-এল-বাহরির গোপন মন্দিরে শেষ শয্যায় শায়িত করা হয়েছিল। এর মধ্যে অধিকাংশ মমি খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩৯ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১০৭৫-এর মধ্যে ‘নতুন সাম্রাজ্য’ শাসনকালের। উনিশ শতকে প্রথম মন্দিরগুলো আবিষ্কৃত হয়।

সাধারণদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ ছিল রাজা দ্বিতীয় রামসেসের মমিকে ঘিরে। প্রায় ৬৭ বছর মিশর শাসন করেছেন এই রাজা। আরেকজন রানি হাতশেপসুত, মিশরের একমাত্র নারী ফারাও। কথিত আছে, তিনি রাজকীয় কার্যক্রমে নারীদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান করার ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নকল দাঁড়ি পরতেন। কবর খননের পর তাদের মমি নীল নদে বিশেষ নৌকায় করে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর কিছু মমি কাঁচের বাক্সে ভরে দর্শনার্থীদের দেখার ব্যবস্থা করা হয়। বাকিগুলো আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এর মধ্যে রাজা দ্বিতীয় রামেসের মমির কিছু অংশ ১৯৭৬ সালে ফরাসি বিজ্ঞানীরা প্যারিসে নিয়ে গোপন সংরক্ষণাগারে রাখেন। এবারও ২০টি মমি প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে। বাকি দুটিকে গোপনে সংরক্ষণ করা হবে।

স্থানান্তর ছাড়াও প্রাচীন মমি নিয়ে এই বিশাল শোভযাত্রা আয়োজনের পেছনে মিশরের আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। আর তা হলো, দেশটির ঝিমিয়ে পড়া পর্যটনে প্রাণ ফিরিয়ে আনা। ২০১১ সালে দীর্ঘ সময়ের একনায়ক হুসনি মোবারকের পতনের জন্য বিখ্যাত তাহরির স্কয়ার থেকে শুরু হওয়া ‘আরব বসন্তের’ পর দেশটির পর্যটন খাত অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এরপর আবার করোনার হানা। এজন্যই এই চমক জাগানিয়া আয়োজন।মমিগুলোকে নতুন জাদুঘরে আমন্ত্রণ জানাতে হাজির হওয়া মিশরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এক টুইটে লিখেছেন, ‘এই জাদুকরি দৃশ্যগুলো এই মানুষগুলোর গরিমার প্রমাণ। ’